Header Ads

Header ADS

মুহাম্মদের বিবাহনামা

 মুহাম্মদের বিবাহনামাঃ




ভূমিকাঃ উম্মুল মুমেনীনদের জীবন-কাহিনী বোঝার জন্য ইসলাম-পূর্ব সময়ের আরবের অবস্থা জানা প্রয়োজন। ইসলাম-পূর্ব সময়ে মূলত দুইটি রাজত্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রন করতো। পার্সিয়ায় (বর্তমান ইরান) সাসানিয়ান সাম্রাজ্য ও এশিয়া মাইনরে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। অপরদিকে আরব ছিলো উত্তপ্ত মরুভূমি, না ছিলো কৃষি, না জল, মানে বলতে গেলে কিছুই না। সেই-সময় আরবে অনেকগুলো ছোট ছোট গোত্র ছিলো, তাদের মধ্যে একটি ছিলো কুরাইশ।বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। কিন্ত এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলো মক্কা। কাবা ছিলো সকল গোত্রের দেবতাদের আবাসস্থল, পবিত্র ভূমি। সেখানে মারামারি হানাহানি সবকিছুই নিষিদ্ধ ছিলো। কাবার ভেতরে প্রায় ৩৬০ টি মূর্তি ছিলো। প্রধান দেবতা ছিলো দুইটি, আল্লাত ও লাত।

এই কারণে মক্কা ছিলো ব্যবসা করার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এজন্য ধীরে ধীরে মক্কা হয়ে উঠলো সেই সময়ের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। এবং মক্কাবাসী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ট্যাক্স পেতো। সেই সাথে হজ্জ থেকেও ভালো অর্থ পেতো( বলে রাখা ভালো, অনেক আগে থেকেই হজ্জ প্রচলিত ছিলো )। এভাবেই সেই তপ্ত মরুভূমিতে থেকেও আরবরা ধনী হয়ে উঠলো। মক্কাবাসী এতোই অভিজাত ছিলো যে বাচ্চা জন্মানোর পর দুধ পান করানোর জন্য আলাদা একজন দুধমা রেখে দিতো। (নবীজির দুধমা হালিমা)। এখন সরাসরি চলে যাই ইসলামের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, মুহম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুয়ালিদের কাছে।


খাদিজা_বিনতে_খুয়াইলিদ, খাদিজাতুল কোবরা, খাদিজা দ্য গ্রেটঃ



খাদিজা সেই সময়ের সবচেয়ে ধনী মহিলা। এখানে বলে রাখা ভালো, ঐসময়ে মক্কায় অনেক প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ ও আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জমিলা তার উদাহরণ। যখন খাদিজার দ্বিতীয় স্বামী আবু হালা মারা যান, ততোদিনে খাদিজা সুপ্রতিষ্ঠিত ও ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ী। উনাকে বিয়ে করার জন্য অনেকেই প্রস্তাব পাঠাতে লাগলেন। তিনি সবাইকেই প্রত্যাখ্যান করে দিতেন।

তাঁর প্রচুর কর্মচারী ছিলো। তিনি বিভিন্ন দ্রব্যাদি যেমন, চামড়া, রেশম, সুগন্ধী, রুপা, কিসমিস এগুলো রপ্তানি করতেন (১)। এইবেলা একটি মজার কথা বলে রাখি। আমরা ইসলাম-পূর্ব যুগ সম্পর্কে যা জানি, সেটি আসলে অনেকটাই ভীন্ন। দাসপ্রথার ভালোই প্রচলন ছিলো এটা যেমন সত্যি, তেমনি হিন্দ বিনতে উতবা(২) এবং আসমা বিনতে মুখারিবার(৩) মত অনেক বিশিষ্ট্য ও সম্মানিত মহিলা ব্যবসায়ী ছিলেন। আরো একটি মজার ব্যাপার হলো, খাদিজার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পর্দা-প্রথা চালু করা হয়নি, মেয়েদের গৃহবন্দী করা হয়নি। খাদিজা হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি মৃত্যুর পর তাঁর মতো স্বাধীন লাইফস্ট্যাইলে চলা ও ঘরের বাইরে বের হওয়া মুসলিম নারীদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।

সময়টা তখন ইংরেজি ৫৯৫ সাল। সিরিয়াতে ব্যবসার জন্য নতুন কর্মচারী দরকার। খাদিজার ভাইয়ের স্ত্রীর ভাই আবু তালিব (৪) একজন তরুণ যুবকের প্রস্তাব দিলেন। তাঁর নাম ছিলো মুহম্মদ(৫)। তখন আবু তালিব আর এতিম মুহম্মদ দুইজনের বেশ দৈন্যদশা ছিলো। সব শুনে খাদিজা নির্ধারিত বেতনের চেয়ে বেশি বেতন দিয়ে মুহম্মদকে নিয়োগ দিলেন। দুই মাস পরে খাদিজা যে পরিমাণ লাভ আশা করেছিলেন তার প্রায় দ্বিগুণ লাভ করে মুহম্মদ ফেরত আসেন (৬)। এরপর আবারো ইয়েমেনে পাঠালেন এবং ভালো লাভ করে ফিরে আসলেন। চটপটে, বুদ্ধিমান, কর্মঠ ও বিচক্ষণ যুবক মুহম্মদকে খাদিজার ভালো লেগে গেলো। তিনি নাফিজা বিনতে উমাইয়াকে পাঠালেন বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য(৭)।  এদিকে মুহাম্মদের পছন্দ ছিলো আবু তালিবের মেয়ে তার চাচাতো বোন উম্মে হানিকে। কিন্তু যেহেতু মুহাম্মদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না সে কারণে চাচা আবু তালিব সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন (৮)। এজন্য নাফিজার প্রস্তাবে তিনি যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বলা বাহুল্য, সাথে সাথেই তিনি রাজি হয়ে যান । ঠিক সেই বছরেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।

এখন আসি আরেকটি মজার এবং অজানা ঘটনায়। খাদিজা জানতেন সাধারণ এক কর্মচারীর কাছে বিয়ে দিতে তার বাবা খুওয়ালিদের রাজি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই তিনি একটি ফন্দি আঁটলেন। তিনি ইচ্ছেমতো বাবাকে মদ খাইয়ে তার পর বরযাত্রীকে বাসায় প্রবেশ করালেন। তৎকালীন প্যাগান রীতি অনুযায়ী তাদের বিয়ে হলো, এবং খুওয়ালিদকে যা বলা হলো তিনি তাই বলে গেলেন। এরপর বিবাহ ভোজ যখন পুরোদমে চলছে তখন খুওয়ালিদের হুঁশ ফিরে আসে। তিনি রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে তলোয়ার বের করলেন। সাথে সাথেই দুই মুহাম্মদের সংগী সাথিরাও তলোয়ার বের করলো। পরে দুই পক্ষের লোকজন চিন্তা করলেন যে বিয়ে যেহেতু সম্পন্ন হয়ে গেছে খামাখা আর রক্তপাত করে লাভ নেই (৯)। মজার ব্যাপার হচ্ছে আধুনিক স্কলাররা এই বিব্রতকর বিয়ের ঘটনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেন। কিন্তু ৯ নম্বর রেফারেন্স দেখলেই বুঝবেন এর পক্ষের রেফারেন্স কতো শক্তিশালী!

এখানে আরেকটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন যে, খাদিজার দাম্পত্য জীবন কিন্তু নবীর বাকি স্ত্রীদের মতো ছিলো না। বরঞ্চ বলা যায় মুহাম্মদ তাকে বেশ সমীহ করেই চলতেন। আর ঐ সময়েও খাদিজা যথেষ্ঠ আকর্ষণীয় ছিলেন। ইতিহাস ঘাটলে বোঝা যায়, মুহাম্মদ খাদিজার প্রতি শুধু যে বিশ্বস্ত ছিলেন তা নয়, সংসার ও ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর বেশিরভাগ খাদিজাই নিতেন (১০)।

মুহাম্মদ-খাদিজা দম্পতি ঐ সময়ের আরবদের চেয়ে চিন্তা চেতনায় অনেক আধুনিক ছিলেন এবং মুক্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন। খাদিজার ঘরে আল-উজ্জার একটি মূর্তি ছিলো এবং খাদিজা নিয়মিত পূজা করতেন (১১)। মজার ব্যাপার হলো কাবার হাজরে আসওয়াতকে তখনো পূজা করা হতো ।  ছোটবেলায় ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়া সেই ঘটনা নিশ্চয়ই মনে আছে? কে পাথর রাখবে এটি নিয়ে যখন ঝগড়া-বিবাদ চলছিলো, তখন মুহাম্মদ অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে একটি চাদরের উপর পাথর রেখে সব গোত্র প্রধানকে চাদর ধরতে বললেন। এই বিচক্ষনতা তাকে অনেক সম্মানিত করলো । কিন্তু তখন পর্যন্ত তিনি কাবার ৩৬০ টি মূর্তির উপর অবিশ্বাসী হয়ে উঠেন নি।

ব্যবসার খাতিরে, তাঁদের অনেক জ্ঞানী-গুনী একেশ্বরবাদী, খ্রিষ্টান,ইহুদী ও জুরুষ্ট্রিয়ান মানুষের সাথে চেনা পরিচয় ছিলো। খাদিজার কাজিন ওয়ারাকা ইবনে নওফেল এবং উসমান ইবনে হুয়াইরিসের কাছ থেকেও প্রচুর গল্প শুনতেন (১২)।

এক পর্যায়ে খাদিজা এবং মুহম্মদ দুজনেই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেন এবং খাদিজা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে সৃষ্টিকর্তা আসলে একজনই (১৩) ।

ঠিক ঐ সময়ে তীব্র মানসিক অস্থিরতা গ্রাস করে মুহম্মদকে। তিনি হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যান করতে শুরু করলেন। একদিন প্রচন্ড ভয় পেয়ে বাসায় ফিরে আসলেন। তিনি বললেন জিব্রাইল আমার কাছে এসেছিলো, আমার মনে হচ্ছে আমাকে কোন খারাপ প্রেতাত্মা আছর করেছে। খাদিজা কম্বল দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, এবং বললেন, তোমার মতো সৎ চরিত্রের মানুষকে কোন প্রেতাত্মা বশ করতে পারবে না। এরপর সেই অবস্থায় মুহম্মদকে তাঁর কাজিন ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের বাড়িতে নিয়ে গেলেন(১৪) । ওয়ারাকাই প্রথম বললেন, যে তুমিই হচ্ছো মুসা নবীর ভবিষ্যতবাণী করে যাওয়া সেই প্রমিজড প্রফেট, সমগ্র মানব জাতির নেতা! কিন্তু ওয়ারাকার কথা শুনেই তাঁর ভয় কাটছিলো না। খাদিজাই সর্বপ্রথম তাকে কনভিন্স করেন, তুমিই হচ্ছো সত্যিকারের নবী (১৫)। এবার তিনি আশ্বস্ত হলেন । কিছুদিন নিয়মিত ওহী আসার পর হটাত করেই ওহী নাজিল হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। তিনি এতে এতোই ডিপ্রেসড হয়ে গেলেন যে তিনি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছিলেন কয়েকবার এবং তাঁর ভাষ্যমতে প্রতিবারই জিব্রাইল সময়মতো এসে বাঁচায় (১৬)। কিন্তু এর পরেও কোন ওহী আসছিলো না দেখে তিনি ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। তখন খাদিজা বললেন, তোমার আল্লাহ মনে হয় তোমাকে ত্যাগ করেছে(১৭) । ঠিক সেই  সময়ই নাজিল হলো সূরা দোহার সেই বিখ্যাত আয়াতসমূহ, “শপথ পূর্বাহ্ণের, শপথ রাত্রির যখন তা গভীর হয়, আপনার পালনকর্তা আপনাকে ত্যাগ করেনি এবং আপনার প্রতি বিরূপও হননি.........।“(অনেকেই এই সূরা এবং তাঁর শানে নজুল ছোটবেলায় ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়ে থাকবেন )

এরপর তিনি আর কখনোই জিব্রাইলকে ভয় পাননি এবং জিব্রাইল প্রায়শই নিত্য নতুন ওহী নিয়ে আসতে লাগলো। আলি, আবু বকর, পালকপুত্র জায়েদ সবাই নিয়মিত পাশে থাকলেও মুহম্মদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিলো খাদিজা। এরপরেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে লাগলো যখন মুহাম্মদ প্রকাশ্যে কাবার সব মূর্তি ত্যাগ করে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। মজার ব্যাপার, সেই ওয়ারাকাই এবার বিরুদ্ধাচরণ করা শুরু করলেন। কিন্তু ঐ প্রচন্ড দুঃসময়ে মুহাম্মদকে ব্যাক আপ দিয়েছেন খাদিজা, আর দুইজনকেই ব্যাক আপ দিয়েছেন চাচা আবু তালিব (১৮) ।

যখন উমর এবং হামজা ইসলাম গ্রহণ করলেন তখন পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে গেলো। সমগ্র মক্কাবাসী নওমুসলিমদের বয়কট করলো। তাঁদের সাথে কেউ ব্যবসা, বানিজ্য কিছুই করবে না। কিন্তু মুহম্মদ ইসলাম প্রচারে অনড় রইলেন। তখন কুরাইশ প্রধান তাকে প্রস্তাব দিলেন, কুরাইশ গোত্রের যতো মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে চাও, বিয়ে করতে দিবো, যত সম্পদ চাও, পাবে, পলিটিক্যাল ক্ষমতা চাও পাবে, কিন্তু শর্ত একটাই, যদি এই পাগলামি বন্ধ করো। মুহাম্মদ ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন (১৯)।

নবুয়ত প্রাপ্তির দশ বছর পর খাদিজা মারা যান (নভেম্বর ৬১৯)(২০)। নবী মুহাম্মদ খাদিজার মৃত্যুর পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন। তিনি আজীবন খাদিজার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “আমি যখন অভাবী ছিলাম তখন খাদিজা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে, কেউ যখন আমাকে বিশ্বাস করতো না, তখন সেই একমাত্র আমাকে বিশ্বাস করেছে, আমার সবচেয়ে বিপদের দিনগুলিতে আমার পাশে থেকেছে, এবং সে আমার সবচেয়ে আদরের কন্যা ফাতেমার মা”

কিন্তু খাদিজার মৃত্যুর পর ইসলাম নতুন বাঁক নেয়, খাদিজার মৃত্যুর পূর্বে ইসলাম ও মুহাম্মদ, এবং মৃত্যুর পরের ইসলাম ও মুহাম্মদ সম্পূর্ণ ভীন্ন! সে গল্পই আসবে অন্য আরেকদিন, পরবর্তী স্ত্রীদের ঘটনাপ্রবাহে!

তথ্যসূত্রসমূহঃ

(১) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ৮২, ৪২৪, ৫৪৭, ৭১৬

(২) ইবনে সাদ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৬৫

(৩) ইবনে সাদ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৯

(৪) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১৬২, ৫৮২, ইবনে সাদ অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৯

(৫) ইবনে ইসহাক, ৮২

(৬) ইবনে সাদ অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ১০

(৭) ইবনে সাদ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ১০, ১৭২।

(৮) তাবারী ৩৯ তম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯৬, ইবনে সাদ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ১০, ১০৯

(৯) তাবারী ষষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা ৪৯, ইবনে সাদ ৩৫ খন্ড পৃষ্ঠা ৪,৫, ইবনে ইসহাক পৃষ্ঠা ৮৩, ইবনে হিশাম পৃষ্ঠা ৯১৮।

(১০) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ৩১৩।

(১১) ইবনে কাসির তাফসীর, সুরা আন নাজম, আয়াত ১৯-২৬।

(১২) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ৯৯।

(১৩) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭

(১৪) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭, তাবারী ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৭২

(১৫) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১১২।

(১৬) তাবারী ষষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা ৭৬, সহীহ বুখারী হাদীস নং ৬৬৯২ (হাদীস নাম্বার একেক সংস্করণে একেক রকম, আপনার বইয়ের নাম বলে সেই বইয়ের কতো নাম্বার হাদীস সেটা বের করে দিতে পারবো।

(১৭) তাবারী ষষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা ৭০।

(১৮) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১৪৬।

(১৯) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১৩২-৩৩, তাবারী ষষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা ১০৬-০৭

(২০) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ১৯১।

সাওদা_বিনতে_জাম’আঃ



খাওলা বিনতে হাকিম ছিলেন শুরুর দিকের ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম। খাদিজা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরে নবী মুহাম্মদ খাওলাকে দুইজনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তাঁদের একজন হলেন সাওদা বিনতে জাম’আ এবং অপরজন আয়েশা বিনতে আবু বকর। সাওদা এবং তার স্বামী সাকরান বিন আমরও প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। মক্কা ফিরে আসার পর যখন সাওদার স্বামী মারা যান তখন বিধবা সাওদাকে মুহাম্মদ বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।

এ বিষয়ে দুটি স্বপ্নের কথা না বললেই নয়। একদিন সাওদা স্বপ্নে দেখলেন যে মুহাম্মদ ধীরে ধীরে হেঁটে এসে সাওদার গলা চেপে ধরেছেন। স্বামীকে স্বপ্নের কথা বলার পর সাকরান বললেন, “তোমার পিতার জীবনের শপথ, তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয় তাহলে আমি মারা যাবো, আর নবী মুহাম্মদ তোমাকে বিয়ে করবেন”। সাওদা আরেকদিন আরেকটি স্বপ্ন দেখলেন,  তিনি বিছানায় শুয়ে রয়েছেন এবং হঠাত আকাশের চাঁদ খসে তাঁর কোলের উপরে পড়লো। একথা স্বামীকে বলার পর স্বামী উত্তর দিলেন, “তোমার পিতার জীবনের কসম, আমার হায়াতের আর বেশী বাকী নেই, এবং শীঘ্রই মুহাম্মদ হবেন তোমার স্বামী” । সত্যি সত্যি এর কিছুদিন পর অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে সাওদার স্বামী সাকরান ইন্তেকাল করলেন(২১) ।

সাওদা ছিলেন মধ্যবয়স্কা, লম্বা, বিশালদেহী, ও ডার্ক স্কিনের অধিকারী। কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন খাদিজার সম্পূর্ণ বিপরীত। খুবই কোমল, মমতাময়ী, ঘরোয়া স্বভাবের, ও আন্তরিক।  আয়েশা বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনায় তাকে বিশালদেহী ও স্থুলকায় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি যখন বিধবা হলেন তখন তাঁর ঘরে ছিলো পাঁচ ছয়জন ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। তাই খাওলার প্রস্তাবে তিনি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। এরপর খাওলা যখন সাওদার বাবা জাম’আকে বললেন তখন জাম’আ উত্তর দিলেন, “এতো আমাদের চরম সৌভাগ্যের বিষয়”!

৬২০ খ্রীস্টাব্দের রমজান মাসে সাওদা ও মুহাম্মদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন ( এপ্রিল কিংবা মে মাসে ) (২২)। বিয়ের সময় সাওদার বয়স কতো ছিলো তার সঠিক কোন  বিবরণ পাওয়া যায় না। এক জায়গায় পাওয়া যায়, ২৭, আরেক জায়গায় ৩৮, আরেক জায়গায় ৫৪। তাবারীর বর্ণনা অনুসারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৬৭৪ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে। সুতরাং সে হিসেবে বিয়ের সময় বয়স ৫৪ হলে মৃত্যুর সময় বয়স হয় ১২০। একথা নিয়ে দ্বিমত নেই যে তিনি দীর্ঘায়ু ছিলেন। কিন্তু বিয়ের সময় বয়সটি যেহেতু অমীমাংসিত সেহেতু সেটি এটি অনুমান করা পাঠকের দায়িত্ব।

বিয়ের পর সাওদা মুহাম্মদের বাড়িতে গিয়ে ঘরদোর সামলানো ও মেয়েদের দেখাশোনা শুরু করেন। এর কিছুদিন পরে নবী মুহাম্মদ আয়েশাকে বিয়ে করলেও আয়েশার শৈশব উত্তীর্ণ না হওয়ায় ঘরে তুলে নেননি। সুতরাং প্রায় তিন বছর সাওদা ছিলেন একমাত্র স্ত্রী। তবে ঐসময় মক্কাবাসী খুব বিস্মিত হয়েছিলো যে মুহাম্মদ কেন সাওদাকে বিয়ে করলেন, কারণ সাওদা অল্পবয়স্কা ছিলেন না, সুন্দরীও ছিলেন না।

এই সাওদাই কিন্তু নবীজীর ঘর আগলে রেখেছেন এবং সংসারের দেখভাল করেছেন।

মুসলিম নারীদের প্রতি পর্দার আয়াত নাজিল হয় সাওদার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি আমরা সরাসরি আয়েশার জবানীতেই শুনি,

“রাতের বেলায় প্রকৃতির ডাকে সারা দেয়ার জন্য নবীর স্ত্রীরা মদীনার বাকিয়ার নিকটে আল-মানাসী নামক একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে যেতেন। উমর প্রায়ই মুহাম্মদকে বলতেন, আপনার স্ত্রীদেরকে পর্দা করতে বলুন। কিন্তু নবী সেটি কানে তুলতেন না।

একদিন রাতে এশার ওয়াক্তে সাওদা বের হলেন প্রাকৃতিক কাজ সম্পাদন করতে। সাওদা যেহেতু ছিলেন বিশালাকায়, তাঁর দেহাবয়ব দেখে উমর দূর থেকেই চিনে ফেললেন। এরপর তিনি চেঁচিয়ে বললেন, হে সাওদা, আমি কিন্তু আপনাকে চিনে ফেলেছি! সাওদা বাসায় ফিরে এসে নবী মুহাম্মদকে সব খুলে বললেন, মুহাম্মদ তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। হাতে একটি মাংসের হাড় ছিলো। তখনই পর্দার আয়াত নাজিল হলো (২৩)।  হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪) “

কিন্তু পরবর্তীতে এই সাওদাই হয়েছেন চরম উপেক্ষিত। নবী মুহাম্মদের ঘরে ততোদিনে আরো চারজন সুন্দরী স্ত্রী, আয়েশা, হাফসা, জয়নব ও উম্মে সালামা। এরমধ্যে আয়েশা ছিলো সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু তিনি যেহেতু সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন সেহেতু পালাক্রমে প্রত্যেকের সাথে একটি একটি করে রাত কাটাতেন। কিন্তু নবী তখন সাওদার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং সাওদাকে তালাক দিতে চান (২৫)। কিন্তু ইবনে কাছিরের ভাষ্য অনুযায়ী, নবী তালাক দিতে চাননি, কিন্তু সাওদা নিজেই ভয় পাচ্ছিলেন যে নবী মুহাম্মদ তালাক দিয়ে দিবেন (২৬)। মূলত এই পরিপ্রেক্ষিতেই সূরা নিসার ১২৮ ও ১৩০ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। আয়াত দুটি হচ্ছে,

"যদি কোন নারী স্বীয় স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে,তবে পরস্পর মীমাংসা করে নিলে তাদের উভয়ের কোন গোনাহ্ নেই। মীমাংসাই উত্তম। তবে মানুষের মনে সংকীর্ণতা, কৃপণতা বিদ্যমান আছে। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং খোদাভীরু হও, (যাই কর না কেন) আল্লাহ্ তোমাদের সব কাজের খবর রাখেন।" (২৭)

"যদি উভয়েই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে আল্লাহ্ তার অপরিসীম দয়া ও করুণার সাহায্যে প্রত্যেককে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন। আল্লাহ্ সুপ্রশস্ত, প্রজ্ঞাময়।" (২৮)

নবী মুহাম্মদ তালাকের কথা বলে থাকুক আর না বলে থাকুক, সাওদা নিজেই গিয়ে মুহাম্মদের কাছে অনুনয় করলেন, তাকে তালাক না দেয়ার জন্য। তাঁর যৌনসম্পর্কের দরকার নেই, শুধুমাত্র স্ত্রী হিসেবে ঘরে থাকতে দিলেই হবে। মুহাম্মদ এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। বিনিময়ে তিনি তাঁর ভাগের রাতটি আয়েশাকে দিয়ে দিবেন (২৯)।

বিভিন্ন আদি উৎসে এর উল্লেখ থাকলেও আধুনিক স্কলাররা ও তাফসীরকারকেরা দাবী করেন সাওদার বয়স হয়ে যাওয়ায় তিনি আর যৌনকর্মে আগ্রহ পাচ্ছিলেন না। তিনি ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে ও সংসার সামলানোতেই বেশি আনন্দ পেতেন। তাছাড়া যেহেতু আয়েশাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন, তাই তিনি নিজের ভাগের রাতটি আয়েশাকে দান করে দেন। স্কলাররা তাঁদের দাবির স্বপক্ষে অনেকগুলো হাদীস দেখান (৩০)।

কারণ যেগুলোই হোক, সাওদা তাঁর জীবদ্দশায় অনেক ত্যাগস্বীকার করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তিনি দীর্ঘ ৪১ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

তিনি উম্মুল মুমিনীন হিসেবে যে মাসোহারা পেতেন তাঁর বেশিরভাগই দান করে দিয়েছেন। ৬৭৪ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সাওদার ভাগের রাত পাওয়া নবীর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীর কথা নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে? আয়েশা আসছেন পরবর্তী পর্বে !

বেশিরভাগ হাদীস 

তথ্যসূত্রঃ

(২১) তাবারী, ৩৯ তম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭০।

(২২) তাবারী, ৩৯ তম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭০। 

(২৩) সহীহ মুসলিম ৫৩৯৫, ৫৩৯৬, ৫৩৯৭, সহীহ বুখারী ৪৭৪৫, ৬২৪০ (হাদীস নাম্বার একেক সংস্করণে একেক রকম, আপনার বইয়ের নাম বলে সেই বইয়ের কতো নাম্বার হাদীস সেটা বের করে দিতে পারবো)

(২৪) সূরা আহজাব, আয়াত ৫৯

(২৫) তাবারী নবম খন্ড পৃষ্ঠা ১২৮-১৩০, ৩৯ খন্ড পৃষ্ঠা ১৬৯-৭০।

(২৬) ইবনে কাসির তাফসীর, সূরা নিসা, আয়াত ১২৮

(২৭) সূরা নিসা আয়াত ১২৮

(২৮) সূরা নিসা আয়াত ১৩০

(২৯) ইসলামিক বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ), নবম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৯-৯০।

(৩০) সহীহ বুখারী ২৫৯৩, ২৬৮৮, সহীহ মুসলিম ৩৪৫১, ৩৪৫২।


                                     আয়িশা_বিনতে_আবু_বকরঃ👇



আয়িশা ছিলেন নবী মুহাম্মদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহচর আবু বকরের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে আয়িশার বয়স ছিলো সবচেয়ে কম এবং তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়। স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন কুমারী। তিনি ছিলেন একজন বিদুষী নারী যিনি একা ২২১০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। বলা হয়ে থাকে তাঁর স্মরণ-শক্তি ছিলো অত্যন্ত প্রখর। তিনি নবী মুহাম্মদের যৌন জীবন সহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিধিনিষেধের হাদীস পুংখানুপুংখভাবে বর্ণনা করেছেন। ইসলামিক স্কলাররা বলে থাকেন এতো অল্প বয়সে বিয়ে না হলে এসব হাদীস জানা সম্ভব হতো না।

এই প্রসঙ্গে আয়েশার বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করা প্রয়োজন।

“তিনি বলেন, রাসুলাল্লাহ বলেছেন, দু’বার আমাকে স্বপ্নযোগে তোমাকে দেখানো হয়েছে। এক ব্যক্তি রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিলো, আমাকে দেখে বললো এ তোমার স্ত্রী। তখন আমি তাঁর পর্দা খুললাম, আর সেটা হলে তুমি। তখন আমি বললাম, এ স্বপ্ন যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তবে তিনি বাস্তবে তাই করবেন(৩১)।"

খাদিজার মৃত্যুর কয়েকমাস পরে নবী মুহাম্মদ যখন আবার বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তখন খাওলা বিনতে হাকিমকে দিয়ে সাওদা আর আয়িশার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। আগের পর্বে আমরা সাওদার ঘটনাটি জেনেছি, এখন আয়িশার ঘটনাটি জানবো।

খাওলা যখন আবু বকরের বাড়িতে যান তখন আবু বকর বাড়িতে ছিলেন না। খাওলা আয়িশার মা উম্মে রুমানকে বললেন, “হে উম্মে রুমান তুমি কি জানো আল্লাহ তোমাদের জন্যে কি আশীর্বাদ এবং সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন?” উম্মে রুমান জিজ্ঞেস করলেন, “কি সেটা?” উত্তরে খাওলা বললেন, “নবীজি আমাকে দিয়ে আয়িশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।“ উত্তরে, রুমান বললেন, “তুমি আবু বকরের জন্য অপেক্ষা করো, তিনি এক্ষুনি চলে আসবেন।“ বাড়ি আসার পর আবু বকর সব শুনে বললেন, “ সে (আয়িশা) তাঁর ভাইয়ের মেয়ের মতো। তাকে বিয়ে করা কি ঠিক হবে? তুমি যাও জিজ্ঞেস করে এসো।“ নবী প্রত্যুত্তরে বলে পাঠালেন, “তুমি যাও গিয়ে বলো, আমি তাঁর (আবু বকরের ) ধর্মের ভাই, সে আমার ধর্মের ভাই। সুতরাং তাঁর কন্যাকে বিয়ে করতে কোন বাধা নেই বরং তা আমাদের জন্য কল্যানকর।“ এরপর আবু বকর সম্মত হলেন, এবং নবী মুহাম্মদের সাথে তাঁর বিয়ে দিয়ে দিলেন যখন আয়িশার বয়স মাত্র ছয় বছর (৩২)।

এ বিষয়ে বুখারীর একটি হাদীস উল্লেখ না করলেই নয়।

হিশাম এর পিতা হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর মদীনার দিকে বের হওয়ার তিন বছর আগে খাদিজা (রাঃ ) এর মৃত্যু হয়। তারপর দু’বছর অথবা এর কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করে তিনি আয়িশা (রাঃ) কে বিবাহ করেন। যখন তিনি ছিলেন ছয় বছরের বালিকা। তারপর নয় বছর বয়সে বাসর উদযাপন করেন (৩৩)।

আয়িশার ছয় বছর বয়সে বিয়ের বয়সটি যুগ যুগ ধরে ইসলামিক স্কলারদের বিব্রত করেছে। তাঁরা বিভিন্নভাবে এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। অনেকে বয়স নির্ণয়ের ভিন্ন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, যেমন অনেকে বলেছেন বয়স গণনা করা শুরু হতো মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকে, আবার অনেকে জাল হাদীস নিয়ে এসে দেখিয়েছেন যে বয়স আসলে ছিলো ১৪, ১৬ কিংবা ১৯। কিন্তু বিয়ের সময় বয়স ছয় বছর ছিলো এটার স্বপক্ষে এতো হাদীস আছে যে, সর্বসম্মতক্রমে ছয় বছর বয়সই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধরা হয় (৩৪)।

মজার ব্যাপার হচ্ছে জাকির নায়েক কিন্তু এই পথে হাটেননি। তিনি ছয় বছর ও নয় বছরের হাদীসটি সহীহ বলে স্বীকার করেছেন এবং সেই সাথে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন অন্যভাবে। তাঁর মতে, বিভিন্ন ফ্যাক্টর যেমন জলবায়ু, আবহাওয়া, হিউমিডিটি, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মাসিক আগে শুরু হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আমি আগ্রহী পাঠকদের জন্য ভিডিওর লিংক সংযুক্ত করে দিচ্ছি (৩৫)।

উনি যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, ইসলামে মাসিক শুরু হওয়ার পূর্বে বিয়ে করা কোন অস্বাভাবিক বিষয় না তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় সূরা তালাকের চার নম্বর আয়াতে,

“তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাঁদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনো ঋতুর বয়সে পৌঁছায় নি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাঁর কাজ সহজ করে দেন (৩৬)।“ এখানে উল্লেখ্য ইদ্দতকাল হলো, তালাক হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী বিয়ের আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময়।

এরপর আসি সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশে। ছয় বছর বয়সে বিয়ে হলেও বিয়ের প্রথম তিন বছর নবী মুহাম্মদ আয়িশার সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হননি, মিলিত হওয়ার প্রথম দিন আয়িশার অনুভূতি কেমন ছিলো চলুন শুনি আয়িশার নিজের মুখেই,

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আমাকে বিবাহ করেন, তখন আমার বয়স ছিল ছয় বছর। তারপর আমরা মদীনায় এলাম এবং বনু হারিস গোত্রে অবস্থান করলাম। সেখানে আমি জ্বরে আক্রান্ত হলাম। এতে আমার চুল পড়ে গেল। পরে যখন আমার মাথার সামনের চুল জমে উঠল। সে সময় আমি একদিন আমার বান্ধবীদের সাথে দোলনায় খেলা করছিলাম। তখন আমার মাতা উম্মে রূমান আমাকে উচ্চ:স্বরে ডাকলেন। আমি তাঁর কাছে এলাম। আমি বুঝতে পারিনি, তার উদ্দেশ্য কী? তিনি আমার হাত ধরে ঘরের দরজায় এসে আমাকে দাঁড় করালেন। আর আমি হাঁফাচ্ছিলাম। শেষে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা প্রশমিত হল। এরপর তিনি কিছু পানি নিলেন এবং তা দিয়ে আমার মুখমণ্ডল ও মাথা মাসেহ করে দিলেন। তারপর আমাকে ঘরের ভিতর প্রবেশ করালেন। সেখানে কয়েকজন আনসারী মহিলা ছিলেন। তাঁরা বললেন, কল্যাণময়, বরকতময় এবং সৌভাগ্যমণ্ডিত হোক। আমাকে তাদের কাছে দিয়ে দিলেন। তাঁরা আমার অবস্থান ঠিক করে দিলেন, তখন ছিল দ্বিপ্রহরের পূর্ব মুহূর্ত। হঠাৎ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - কে দেখে আমি হকচকিয়ে গেলাম। তাঁরা আমাকে তাঁর কাছে তুলে দিল। সে সময় আমি নয় বছরের বালিকা (৩৭) ।

সেই সময় মুহাম্মদের বয়স ছিলো ৫৪। খাদিজার পরে আয়িশাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে আয়িশার বান্ধবীরা আয়িশার সাথে পুতুল খেলতে আসতেন। নবী মুহাম্মদ ঘরে ঢুকলে তাঁর বান্ধবীরা পুতুলগুলো লুকিয়ে ফেলতেন।

তখন তিনি পুতুলগুলো বের করে দিয়ে খেলতে বলতেন, কখনো কখনো নিজেও খেলায় অংশগ্রহণ করতেন (৩৮) । তিনি মাঝে মাঝে আয়িশার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। মাঝে মাঝে আয়িশাকে জিততে দিতেন, মাঝেমধ্যে নিজে জিততেন (৩৯) ।

নবীর পরিবারে আয়িশা ছিলেন সবচেয়ে ছোট। এমনকি ছোটমেয়ে ফাতিমার চেয়েও আট বছরের ছোট। সম্ভবত এই কারণে মুহাম্মদ অন্য স্ত্রীদের থেকে আয়েশাকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু অপরদিকে খাদিজা ও তাঁর মেয়ে ফাতিমার জন্য নবী মুহাম্মদের ভালোবাসা ছিলো নিখাদ ও গভীর। আয়িশা খাদিজার প্রতি ঈর্ষা বোধ করতেন। সম্ভবত এই কারণে ফাতিমার সাথেও তাঁর সম্পর্ক খুব বেশি ভালো ছিলো না। সম্প্রতি জনপ্রিয় বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী একটি বক্তৃতায় এটি উল্লেখ করলে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। শুনতে খারাপ লাগলেও ঘটনাটি কিন্তু সত্যি। চলুন শুনে আসি আয়িশার নিজ মুখেই।

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর অন্য কোন স্ত্রীর প্রতি এতটুকু ঈর্ষা করিনি যতটুকু খাদীজাহ (রাঃ) - এর প্রতি করেছি। অথচ আমি তাঁকে দেখিনি। কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কথা বেশি সময় আলোচনা করতেন। কোন কোন সময় বকরী যবেহ করে গোশতে্‌র পরিমাণ বিবেচনায় হাড়-গোশত্‌কে ছোট ছোট টুকরো করে হলেও খাদীজাহ (রাঃ) - এর বান্ধবীদের ঘরে পৌঁছে দিতেন। আমি কোন সময় ঈর্ষা ভরে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - কে বলতাম, মনে হয় খাদীজাহ (রাঃ) ছাড়া দুনিয়াতে যেন আর কোন নারী নাই। উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন, হাঁ। তিনি এমন ছিলেন, এমন ছিলেন, তাঁর গর্ভে আমার সন্তানাদি জন্মেছিল (৪০) ।

সবচেয়ে পছন্দের স্ত্রী হওয়ায় মুহাম্মদ প্রায়ই তাকে বিভিন্ন সফরে নিয়ে যেতেন, নিজের কাঁধের উপরে উঠিয়ে মল্লযুদ্ধ দেখিয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংলাপে পাশে রেখেছেন। যার কারণে পরবর্তী জীবনে আয়েশা রাজনীতি, কুটনীতি, সমরনীতি ও যুদ্ধের কলা-কৌশলে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।

আয়িশার জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম  একটি এমনই এক সফরে। বনু আল মুসতালিক গোত্রের উপর সফল হামলা শেষে মদিনায় ফেরার একটা পর্যায়ে আয়িশা মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। রাতের একটি সময় থেকে পরদিন প্রায় দুপর পর্যন্ত মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। আয়েশার ভাষ্য অনুযায়ী রাতের বেলা প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করে ফিরে এসে দেখেন তাঁর গলার পুঁতির নেকলেস নেই। তখন তিনি আবার সেই জায়গায় ফিরে যান এবং আবার খুঁজাখুঁজি করতে থাকেন।

ওজনের তারতম্য টের না পাওয়ায় আয়েশাকে বহনকারী উটের জকি আয়েশাকে ছাড়াই রওনা দিয়ে দেয়। এরপর তিনি ফিরে এসে দেখেন সবাই চলে গেছে। তখন নিজেকে ঢিলে পোশাকে আবৃত করে সেই জায়গায় শুয়ে থাকেন এই ভরসায় যে তারা আয়িশার অনুপস্থিতি টের পেয়ে আবার ফিরে আসবে। ঐ সময়ে অজ্ঞাত কিছু কাজের জন্য আরেকজন সেনাসদস্য সাফওয়ান বিন আল মুয়াত্তাল আল সুলামি পিছিয়ে পড়েন। তিনি আয়িশাকে দেখতে পেয়ে নিজের উটের পিঠে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন এবং পরদিন দুপুরে মূল দলের সাথে মিলিত হন (৪১)। এরপর মদিনা ফেরার পর আয়িশা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এই সময় নবী মুহাম্মদ আগের মতো সেবাশুশ্রূষা ও খাতির যত্ন করেন না। আয়েশা নবীর ব্যবহারে চরম উদাসীনতা ও অবহেলা লক্ষ করেন। তিনি আয়িশাকে মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন এবং প্রায় বিশ দিন পর আয়িশা সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। এরপর তিনি উম্মে মিসতাহ বিনতে আবু রুহমের কাছ থেক প্রথম শুনতে পান যে সেই রাতের ঘটনা নিয়ে মদিনাবাসীর মধ্যে বেশ কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।

গুজব যখন প্রবল আকার ধারণ করে তখন মুহাম্মদ পরামর্শের জন্য দুইজন ঘনিষ্ট সাহাবী আলি ও উসামা বিন জায়েদকে তলব করলেন। উসামা বিন জায়েদ আয়িশার প্রচুর প্রশংসা করলেন, কিন্তু আলি বললেন, “অনেক মহিলা আছে বিয়ের জন্য, আপনি চাইলেই একজনের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন।“

দ্বিধাদন্দে ভুগে মুহাম্মদ ক্রিতদাসী বুরাইরাকে তলব করলেন। বুরাইরাকে দেখেই আলি উঠে গিয়ে তাকে প্রচন্ড মারধোর করতে থাকেন এবং বলেন, “যা জানো আল্লাহর নবীকে সেটি সত্যি করে বলো”, বুরাইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি আয়িশার মধ্যে কখনো কোন দোষ দেখি না। তাঁর একটি মাত্র দোষ দেখেছি, তাকে যখন ময়দার দলা দেখে রাখতে বলি তখন সে ঠিকমতো দেখে রাখতে পারে না আর তখন ভেড়ার বাচ্চারা এসে সেই ময়দা খেয়ে ফেলে” (৪২)।

এরপর নবী আয়িশার কাছে এসে বললেন, “ লোকেরা যা বলছে তুমি যে সেরকম পাপ করে থাকো তাহলে তাওবা করো এবং অনুশোচনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের তাওবা কবুল করেন”। উত্তরে আয়িশা বলেন, “আমি তাওবা করবো না, আল্লাহর কসম, আমি জানি এবং আল্লাহ জানেন আমি নির্দোষ”।

নবী এরপর খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কোন কুলকিনারা পেলেন না। তারপর হঠাত একসময় তিনি স্বাভাবিক হন। আয়েশাকে বলেন, “সুখবর আয়েশা,  আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী এসেছে, তুমি নির্দোষ।“ আয়েশা বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌।“ এরপর নবী বাইরে গিয়ে ঘোষণা দেন, ওহী অবতীর্ণ হয়েছে যে আয়েশা নির্দোষ, তিনি সদ্য নাজিল হওয়া সূরা নূর পড়ে শোনান এবং ৪ নং আয়াত অনুসারে মিথ্যা রটনাকারীদের শাস্তির ঘোষণা দেন (৪৩)। সূরা নুরের চার নম্বর আয়াতে বলা হয়,

“আর যারা সচ্চরিত্রা নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে না আসে, তাদেরকে তোমরা আশিটি বেত্ৰাঘাত কর এবং তোমরা কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করবে না; এরাই তো ফাসেক (৪৪)।“

এরপর আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে, প্রধান রটনাকারী হিসেবে মিসতাহ বিন উথাথা, হাসান বিন থাবিত ও হামনা বিন জাহাশকে আশিটি করে বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেন (৪৫) ।

ঘটনার গ্রাভিটি বুঝতে হলে ইসলামে ব্যভিচার সম্পর্কিত আইন জানতে হবে। ইসলামে ব্যভিচার প্রমাণ করার উপায় মূলত তিনটি।

১. চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে। অর্থাৎ চারজন পুরুষ যদি যৌনকর্মের প্রতক্ষ্যদর্শী হয়।

২. অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি চারবার স্বীকার করে যে সে দোষী।

৩. যৌনকর্মের যদি কোন দৃশ্যমান প্রমাণ পাওয়া যায়, অর্থাৎ নারী যদি গর্ভবতী হয়।

এখন অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তাহলে অবিবাহিতদের জন্য শাস্তি একশোটি বেত্রাঘাত, আর দোষী বিবাহিত হলে শাস্তি একশোটি বেত্রাঘাতের পর বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা (৪৬) । প্রায় একমাস থমথমে পরিস্থিতির পর আল্লাহর হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিমাংসা হওয়ার পর আয়িশা সসম্মানে তাঁর স্থান ফেরত পান।

সেই রাতে সেই মরুপ্রান্তরে কি হয়েছিলো সেটি একমাত্র আয়িশা আর সাফওয়ান ছাড়া কেউ জানে না। জানা সম্ভবও না, একমাত্র যদি না টাইম মেশিনে চড়ে ঠিক সেই সময়ে ফেরত যায়। তবে এটুকু সত্যি, আমরা ঘটনা যতটুকু জানি সবটুকুই আয়িশার মুখ থেকে শোনা। আর ওইসময় আয়িশা যদি নির্দোষ প্রমাণিত না হতো তাহলে ইসলাম অনুসারে আয়িশার শাস্তি হতো বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হতো। আয়িশা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াক আর না জড়াক, এটুকু আমরা বলতেই পারি যে আয়িশা যদি শাস্তি পেতো তাহলে একজন চৌদ্দ বছরের কিশোরীর জন্য শাস্তিটুকু হতো ভয়ংকর, অমানবিক ও বীভৎস।

নবী মুহাম্মদের বাড়িতে আয়িশা বেশ আদর যত্নে বড় হয়েছেন। নবীর দ্বিতীয় স্ত্রী সাওদা তাঁকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছেন (৪৭) এবং তাঁর নিজের রাতটি দান করেছিলেন (২য় পর্ব) । আয়িশার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো উমরের কন্যা ও নবী মুহাম্মদের চতুর্থ স্ত্রী হাফসা। দুইজন মিলে বাকি স্ত্রীদের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করতেন। মুহাম্মদের আরেক স্ত্রী সাফিয়াকে এই দুইজন কি রকম বিদ্রুপ উপহাস করেছেন এবং মুহাম্মদ, উমর ও আবুবকরের বিরক্তির কারণ হয়েছেন সেটি আমরা জানবো সাফিয়ার পর্বে। শুধু তাই না, আয়িশা ও হাফসা দুইজন একসাথে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে সমস্ত স্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটি আলোচনা হবে পরবর্তী পর্ব অর্থাৎ হাফসার পর্বে।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুহাম্মদের কাছে আয়িশা সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। এবং মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন এই আয়িশার ঘরেই, প্রিয়তমা আয়িশার কোলে।

নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আয়িশার পিতা আবুবকর নির্বাচিত হন প্রধান খলিফা। খলিফার মেয়ে ও নবীর স্ত্রী হওয়ার কারণে আয়িশারও প্রভাব অনেক বেড়ে যায়। এরপর আবু-বকর ও উমরের সাথে নবীকন্যা ফাতেমা ও তাঁর স্বামী আলির বিবাদ শুরু হয়। হাশেমী বংশের আলির অনুসারীরাই মূলত শিয়া যারা আবু বকর, উমর, আয়িশা কিংবা হাফসাকে পছন্দ করেন না। শিয়ারা এও অভিযোগ করেন, আয়িশা ও হাফসা নবীকে স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে হত্যা করেছেন। যদিও এ দাবীর কোন ভিত্তি নেই।

আবু বকর ও উমরের শাসনামলে আয়িশা সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিপত্তি বাঁধে উসমানের শাসনামলে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব হওয়ায়। নবী মুহাম্মদের আরেক সাহাবী আমর ইবনে ইয়াসিরকে বেত্রাঘাত করায় আয়িশা প্রকাশ্যে উসমানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। উসমানের সাথে আয়িশার মুখোমুখি তর্ক হয় এবং উসমান আয়িশাকে মনে করিয়ে দেন, যে ইসলাম মেয়েদেরকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে, বাইরের কোন বিষয়ে নাক গলাতে বলেনি (৪৮)।

উসমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠলে ৬৫৫ সালে বিদ্রোহীদের একাংশ উসমানের বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করেন। বিদ্রোহীরা এরপর আলিকে খলিফা হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আলি প্রথমে ইতস্তত করলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যান। উসমানের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আলি কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় আয়িশা আলির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ গড়ে তোলেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ইসলামের ইতিহাসে এই ঘটনাটি প্রথম ফিতনা নামে পরিচিত (৪৯)।

তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বসরায় গমন করেন এবং সেখানে বসরার প্রধান মসজিদের সামনে আলির অনুসারী প্রায় ৬০০ মুসলিমকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

খবর পেয়ে আলি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ছুটে আসেন এবং এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আয়িশা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন। আয়িশা উটের পিঠের উপরে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন বলে যুদ্ধটি উটের যুদ্ধ বা ব্যাটেল অফ ক্যামেল নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার মুসলিম মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের পর আলি আয়িশাকে ক্ষমা করে দেন এবং মদিনায় নির্বাসন দেন এই মর্মে যে আয়িশা আর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। নবীর স্ত্রী হিসেবে আলি আয়িশাকে নিয়মিত ভাতা পাঠাতেন (৫০)।

উটের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর আয়িশা রাজনীতি থেকে পুরোপুরি অবসর নেন। এর বদলে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি মদিনায় মেয়েদের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অসংখ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং মদিনাবাসীর কাছে একজন বিদুষী রমনী হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য় সুত্রমতে তিনি ৬৭৮ সালের ১৬ই জুলাই ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (৫১)।  কিছু কিছু সুত্রমতে আলির পরবর্তী খলিফা মুয়াবিয়া তাকে হত্যা করেন(৫২)। বিখ্যাত হাদীস বিশারদ আবু হুরায়রা তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন। জান্নাতুল বাকীতে নবীর অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে দাফন করা হয় (৫৩)।

নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে আলির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনাগুলো অনেক ঘোলাটে এবং প্রায় আমাদের অজানা। তাবারীর ৯ম, ১৫তম, ১৬ তম ও ১৭ তম খন্ড বিস্তারিতভবে পড়লে সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা লাভ করা যায়। আয়েশা তো অনেক হলো, আয়েশার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ও মুহাম্মদের অপর স্ত্রী হাফসার কথা না জানলে আয়েশার জীবনী অনেকাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সুতরাং নবী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর চতুর্থ স্ত্রী হাফসা বিনতে উমর আসছেন পরবর্তী পর্বে!

তথ্যসুত্রঃ

(৩১) সহীহ বুখারী হাদীস ৫০৭৮, আধুনিক প্রকাশনী ৪৭০৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন ৪৭০৭।

(৩২) তাবারী নবম খন্ড, পৃষ্ঠা ১২৯-১৩০, ৩৯তম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৪।

(৩৩) সহীহ বুখারী হাদিস ৩৮৯৬।

(৩৪) সহীহ বুখারী হাদীস ৩৮৯৬, ৫১৩৩, সহীহ মুসলিম ৩৩১০, ৩৩১১, সুনানে আবু দাউদ ২১১৬, ২১২১।

(৩৫) https://www.youtube.com/watch?v=avrog9uG5Z4

(৩৬) সূরা তালাক, আয়াত ৪ ।

(৩৭) সহীহ বুখারী হাদীস ৩৮৯৪, সহীহ মুসলিম ৩৩০৯ ।

(৩৮) সহীহ বুখারী ৬১৩০, সহীহ মুসলিম ২৪৪০ ।

(৩৯) সুনানে আবু দাউদ ২৫৭৮ ।

(৪০) সহীহ বুখারী ৩৮১৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫৩৬, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৪৩।

(৪১) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ৪৯৩-৯৫, সুনানে আবু দাউদ ৩৯২০

(৪২) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ৪৯৬।

(৪৩) সূরা নূর পুরোটা তাফসীর সহ পড়া রিকমেন্ডেড।

(৪৪) সূরা নূর, আয়াত ৪।

(৪৫) ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা ৪৯৭ ।

(৪৬) ইবনে কাছিরের তাফসির, সূরা নূর, সহীহ মুসলিম হাদীস ৪১৯২,৪১৯৪, ৪১৯৬, ৪২০৬, ৪২০৯, সহীহ বুখারী ৬৮১২ ।

(৪৭) সহীহ মুসলিম ৩৪৫১।

(৪৮) নাদিয়া এবট, পৃষ্ঠা ১০৮-১১১।

(৪৯) ল্যাপিডাস, পৃষ্ঠা ৪৭, হল্ট, পৃষ্ঠা ৭০-৭২, তাবাতাবেই, পৃষ্ঠা ৫০-৫৭, আল আথির, পৃষ্ঠা ১৯।

(৫০) মুইর ১৫০।

(৫১) হায়লামাজ, পৃষ্ঠা ১৯২-৯৩।

(৫২) ইউসুফ ইবনে কাজগালি, পৃষ্ঠা ৬২, হাকিম সানাই পৃষ্ঠা ৬৫-৬৭, কাশিম চিশতি পৃষ্ঠা ২১৬-১৮, ৬১৬।

(৫৩) ইবনে কাসির পৃষ্ঠা ৯৭।


হাফসা_বিনতে_উমরঃ

হাফসা ছিলেন নবী মুহাম্মদের আরেক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী উমরের মেয়ে। তিনি ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী, সেই সাথে সাহসী, তেজস্বী, দৃঢ়চেতা ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন নারী। হাফসা নামের অর্থও কিন্তু সিংহশাবক। নবী মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে শুধুমাত্র আয়িশা এবং হাফসাই স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতেন। হাফসার সবচেয়ে বড় গুণ যা তাঁকে অনন্য করে তুলেছিলো সেটি হচ্ছে তাঁর শিক্ষা, জ্ঞান-পিপাসা। তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। সেই সময়ের কথা যখন নারীদের মধ্যে তো বটেই, পুরুষদের মধ্যেও লিখতে ও পড়তে জানা লোক পাওয়া খুব দুষ্কর ছিলো।

হাফসার প্রথমে বিয়ে হয় খুনাইস ইবনে হুদাইফার সাথে এবং হাফসা বিধবা হন ৬২৪ সালের অগাস্ট মাসে (৫৪) । ইদ্দতকাল পার হওয়ার পর উমর প্রথমে গেলেন উসমানের কাছে। উসমান বললেন, “আমাকে কিছুদিন চিন্তা করতে দাও”, কিছুদিন অপেক্ষা করে আবার উসমানের কাছে গেলে উসমান জানিয়ে দেন এই মুহূর্তে তাঁর বিয়ের কোন পরিকল্পনা নেই। কিঞ্চিৎ মনক্ষুণ্ণ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এরপর তিনি গেলেন আবু বকরের কাছে। কিন্তু আবুকর কোন উত্তর না দিয়ে মৌনব্রত পালন করেন। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও রাগান্বিত হয়ে তিনি গেলেন নবীর কাছে। নবী মুহাম্মদ মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “উসমান তোমার মেয়ের চেয়েও উত্তম স্ত্রী পাবে, এবং তোমার মেয়েও উসমানের চেয়ে উত্তম স্বামী পাবে। ” পরবর্তীতে উসমানের বিয়ে হয়েছিলো নবীর দুই কন্যা রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সাথে (একজনের মৃত্যুর পর আরেকজন ) এবং ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে নবী মুহাম্মদ নিজে বিয়ে করেন হাফসাকে। পরবর্তীতে আবু বকর উমরকে বলেছিলেন, “আমি প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমার উপরে খেপে গিয়েছিলে তাই না? আসলে আল্লাহর নবী যদি হাফসার প্রতি আকর্ষিত না হতেন তাহলে অবশ্যই আমি বিয়ে করতাম, এবং নবীজি যে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন এই কথাটা তখন তোমার থেকে গোপন রেখেছিলাম (৫৫) ।“

আয়িশার মতো প্রায় একই রকম নির্ভীক ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী হওয়ায়ই সম্ভবত আয়িশার সাথে সবচেয়ে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিলো। হাফসার তেজের বর্ণনা পাওয়া যায় এমন একটি ঘটনায়। একদিন উমর ইবনে খাত্তাবের সাথে তাঁর স্ত্রী জয়নব বিনতে মাধুনের কোন একটি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো। কথাপ্রসঙ্গে, তাঁর স্ত্রী বললেন, “আপনি এই কাজটি যদি এভাবে করতেন তাহলে আরো বেশি ভালো হতো,” শুনে উমর ভীষণ খেপে গেলেন এবং বললেন, “মহিলা, তোমার সাহস তো কম না, তুমি আমার মুখের উপর কথা বলো!” উত্তরে উমরের স্ত্রী বললেন, “কি আশ্চর্য ! আমার এই কথাতেই রেগে গেলেন! অথচ আপনার মেয়ে যে আল্লাহর নবীর সাথে তর্ক করতেই থাকে এবং কখনো কখনো আল্লাহর নবী সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকেন।“শুনে একমুহূর্ত দেরী না করে উমর নিজের মেয়ের বাড়ি চলে গেলেন। এবং গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যা শুনেছি সেটি কি সত্যি? তুমি কি সত্যিই আল্লাহর নবীর সাথে তর্ক করো?” উত্তরে হাফসা বললেন, “অফকোর্স আই ডু!!, অবশ্যই আমি তর্ক করি!” শুনে উমরের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেলো, তিনি রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে গেলেন এবং প্রহার করতে উদ্যত হলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলেন নবী মুহাম্মদ। তিনি উমরকে গায়ে হাত তুলতে দিলেন না এবং ঘর থেকে বের করে দিলেন। উমর তখন হাফসার ব্যাপারে পরামর্শের উদ্দেশ্য নিয়ে নবীর আরেক স্ত্রী উম্মে সালামার কাছে গেলেন। সব শুনে উম্মে সালামা বললেন, “সমস্যা কি আপনার? সবকিছুতে কেন আপনার নাক গলাতে হবে? আপনি কি এখন আল্লাহর নবী এবং তাঁর স্ত্রীদের আভ্যন্তরীণ পারিবারিক বিষয়েও নাক গলাবেন? এরপর সেখানে সুবিধা করতে না পেরে উমর সেখান থেকে চলে গেলেন (৫৬) ।

নবীর জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ঘটনাগুলোর একটি সাক্ষী হচ্ছেন এই হাফসা বিনতে উমর। সম্ভবত ৬২৮ কিংবা ৬২৯ সালের ঘটনা। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনস্ত তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার (বর্তমান মিশর ) সম্রাট আল -মুকাওকিস নবী মুহাম্মদকে দুজন দাসী ও একজন দাস উপহার দেন। দাসীর দুইজনের নাম ছিলো যথাক্রমে শিরিন ও মারিয়া কিবতিয়া। দাসী শিরিনকে উপহার হিসেবে দেন সেই হাসান ইবনে সাবিতকে যাকে কিছুদিন আগেই আয়েশার নামে অপবাদ দেয়ার কারণে বেত্রাঘাত করা হয়েছে (৩য় পর্ব)।  অপরদিকে খ্রিস্টান দাসী মারিয়া কিবতিয়া ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, শেতাঙ্গিনী ও পিঙ্গলকেশী(৫৭)। ঘটনাক্রমে একদিন হাফসার পালার দিন হাফসা তাঁর বাবা উমরের বাড়িতে গেলেন (কোন কোন বর্ণনামতে মুহাম্মদ নিজেই পাঠিয়েছিলেন)। ফিরে এসে তিনি তাঁর নিজের ঘরে নিজের বিছানায় নবী মুহাম্মদ ও মারিয়াকে সংগমরত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি তীব্র রাগে, দুঃখে, হতাশায় শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, “তাই বলে আমারই পালার দিনে, আমারই ঘরে, আমারই বিছানায়?” নবী মুহাম্মদ তখন উঠে এসে হাফসাকে বললেন, “শান্ত হও হাফসা, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি মারিয়াকে আমার জন্য হারাম করে নিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও এই বিষয়ে কাউকে বলতে পারবে না।“ হাফসা কথা দিলেন, কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। তিনি বিষয়টি তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আয়িশার সাথে শেয়ার করলেন এবং সব শুনে আয়িশাও তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। এরপর হাফসার অনুমতিতে আয়িশা নবীর বাকী স্ত্রীদেরকেও ঘটনাটি বললেন। নবীর অন্দরমহলে তীব্র অসন্তোষ শুরু হলো। এই প্রথম নবীর নয়জন স্ত্রী একজোট হয়ে নবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলেন। নবী অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তখন নবী রাগ করে প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি একমাস তাঁর স্ত্রীদের সাথে যেকোনপ্রকার সাক্ষাৎ বন্ধ রাখবেন। ঠিক ওইসময় নাজিল হলো সূরা আত-তাহরীমের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ (৫৮)ঃ

১। হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। ( তিনি হাফসাকে যে কথা দিয়েছিলেন মারিয়াকে হারাম করে নিবেন সেই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে )।

২। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক। তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (তিনি মারিয়াকে হারাম করে নিলাম বলে কসম কেটেছেন, সেই কসম থেকে চাইলে অব্যাহতি নিতে পারেন)।

৩। যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন, তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেন,ঃ যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন (হাফসার আয়িশাকে বলে দেয়া ) ।

৪। তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা কর, তবে ভাল কথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তুত ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী (আয়িশা ও হাফসাকে উদ্দেশ্য করে )।

৫। যদি নবী তোমাদের সকলকে পরিত্যাগ করেন, তবে সম্ভবতঃ তাঁর পালনকর্তা তাঁকে পরিবর্তে দিবেন তোমাদের চাইতে উত্তম স্ত্রী, যারা হবে আজ্ঞাবহ, ঈমানদার, নামাযী তওবাকারিণী, এবাদতকারিণী, রোযাদার, অকুমারী ও কুমারী (৫৯) ।

আয়াত নাজিল হওয়ার পরে এই গুজব রটে গেলো যে নবী বুঝি স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়েছেন বা দিয়ে দিচ্ছেন। উমর এবং আবু বকর সাথে সাথেই নবীর বাড়িতে ছুটে গেলেন। ঘটনাটুকু সরাসরি উমরের বর্ণনা থেকেই শুনে নিই,

“এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাস্‌সানের শাসনকর্তা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করছে। আমার প্রতিবেশী আনসার তার পালার দিন রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর খিদমাত থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় খুব জোরে করঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কিনা? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গ্যাস্‌সানিরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তাঁর চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহধর্মিণীগণকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফ্‌সা তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হলো। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শিগগিরই এ রকম কিছু ঘটবে। এরপর আমি পোশাক পরলাম এবং ফাজ্‌রের সলাত নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর সঙ্গে আদায় করলাম। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহন করলেন, আমি তখন হাফ্‌সার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে আগেই সতর্ক করে দেইনি? নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদের সকলকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন? সে বলল আমি জানি না। তিনি ওখানে ওপরের কামরায় একাকী রয়েছেন। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে মিম্বারের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমার প্রাণ এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিল না। সুতরাং যে ওপরের কামরায় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থান করছিলেন আমি সেই ওপরের কামরায় গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদিমকে বললাম, তুমি কি ‘উমারের জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে? খাদিমটি গেল এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর সঙ্গে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর কাছে আপনার কথা বলেছি, কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম, তুমি কি ‘উমারের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে গেল এবং ফিরে এসে বলল, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর কাছে আপনার কথা বলেছি কিন্তু তিনি নিরুত্তর ছিলেন। তখন আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সঙ্গে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার আকছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি ‘উমারের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, এমন সময় খাদিমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইর ওপর চাদরবিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে পরিস্কার চাটাইয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি কি আপনার স্ত্রীগণকে ত্বলাক দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না (অর্থাৎ ত্বলাক দেইনি)। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার। এরপর কথাবার্তা হালকা করার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি যদি শোনেন তাহলে বলিঃ আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের উপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাতাম; কিন্তু আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের উপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুচকি হাসলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নজর দেন। আমি হাফ্‌সার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে। এর দ্বারা ‘আয়িশা (রাঃ) - এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার মুচকি হাসলেন। আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তাঁর ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। আল্লাহ্‌র কসম! কেবল তিনটি চামড়া ব্যতীত আর আমি তাঁর ঘরে উল্লেখ করার মত কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! দু’আ করুন, আল্লাহ্‌ তা’আলা যাতে আপনার উম্মাতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা, পারসিক ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার আরাম প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে; অথচ তারা আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাত করে না। এ কথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে! আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল, আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করুন। হাফ্‌সা (রাঃ) কর্তৃক ‘আয়িশা (রাঃ) - এর কাছে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঊনত্রিশ দিন তাঁর স্ত্রীগণ থেকে আলাদা থাকেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি গোস্বার কারণে। তখন আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম ‘আয়িশা (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে দিয়েই শুরু করলেন। ‘আয়িশা (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি কসম করেছেন যে, একমাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো ঊনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন। আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও একমাস হয়। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এ মাস ২৯ দিনের। ‘আয়িশা (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ্‌ তা’আলা ইখতিয়ারের আয়াত অবতীর্ণ করেন (৬০) এবং তিনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে আমাদে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি। এরপর তিনি অন্য স্ত্রীগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা ‘আয়িশা (রাঃ) বলেছিলেন (৬১)।“

উপরে বর্ণিত ঘটনাটি আয়িশার বয়সের মতোই যুগ যুগ ধরে ইসলামিক স্কলারদেরকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। তাঁরা সূরা তাহরিমের তাফসীর বর্ণনার সময় উপরের ঘটনাটির উল্লেখ করলেও ঘটনাটিকে গারীব (অপেক্ষাকৃত কম গ্রহণযোগ্য) বলে সেই সাথে বিকল্প অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। ঘটনাটি উইকিপিডিয়া থেকে সরাসরি কপি পেস্ট করে দিচ্ছি এখানে,

“নবী(সা.) প্রতিদিন আসরের সালাতের পর তার স্ত্রীদের কক্ষ পরিদর্শন করতেন এবং তাদের খোঁজখবর নিতেন। একবার তার এক স্ত্রী জয়নব বিনতু জাহাশ এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু মধু পেলেন। এরপর থেকে যখনই নবীজী (সা.) জয়নবের ঘরে আসতেন, জয়নব তাকে কিছু মধু দিতেন,যা নবীজি (সা.) খুব পছন্দ করতেন। এরপর থেকে সবসময় মধু পান করার কারণে জয়নবের ঘরে নবীজি(সা.) অধিক সময় ব্যয় করতেন। এ ঘটনায় তার দুইজন স্ত্রী আয়িশা ও হাফসা ক্ষুব্ধ হলেন এবং একটা ফন্দি আঁটলেন। নবীজি (সা.) তাদের ঘরে একে একে গেলে তারা দুজনেই আলাদাভাবে নবীজিকে (সা.) বললেন, তারা নবীজির (সা.) মুখ থেকে দুর্গন্ধময় মাগাফির নামক কিশমিশের গন্ধ পাচ্ছেন। তিনি তা খেয়েছেন কিনা। উত্তরে তিনি তাদের বললেন যে তিনি জয়নবের কাছ থেকে মধু খেয়েছেন এবং তিনি আর কখনো সেটি খাবেন না। এর পরপরই সুরা তাহরিমের একটি আয়াত নাজিল হয় যাতে বলা হয়, আল্লাহ বলেছেন আল্লাহ কর্তৃক বৈধকৃত সকল খাবার তিনি খেতে পারবেন।

হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশি করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন ? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক। তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

— কুরআন, সুরা ৬৬ (আত-তাহরিম), আয়াত ১-২

এ ঘটনার পর লোকে বলাবলি করতে থাকে যে, রাসুল (সা.) এর স্ত্রীগণ তার সাথে ধারালোভাবে কথা বলছে এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এ ঘটনার কারণে নবী অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। নবীজি (সা.) দীর্ঘ এক মাস তার স্ত্রীগণের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ রাখলেন। হাফসাকে তার পিতা উমর (রা.) খুব শাসালেন এবং তা নবীজি (সা.) কে বললেন। অবশেষে, নবীজি (সা.)এর স্ত্রীগণ তার প্রতি অণুগত হলেন এবং সত্য কথা বলতে, বিনীত আচরণ করতে, এবং পরকালীন জীবনের প্রতি মনোযোগী হতে সম্মত হলেন (৬২)। “

মধু খাওয়া নিয়ে এতো বড় ঘটনা ঘটা এবং আয়াত নাজিল, নাকি মারিয়াকে নিয়ে ঘটনার সুত্রপাত এটা বিচারের ভার একান্তই পাঠকের। তবে বেশ মজার একটা ব্যাপার, আধুনিক কালের অনেক অনুবাদকই ইবনে কাছিরের অনুবাদ করার সময় মারিয়ার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ অবাক হয়েছি যখন দেখেছি সহীহ ইন্টারন্যাশনালের ইংরেজি অনুবাদেও এই অংশটুকু নেই। আমি বাংলা হাদীসের জন্য যে এপ ব্যবহার করি (Al-Hadith) সেই এপেও সহীহ বুখারীর ৪৭৮৭ নম্বর হাদীসের পর  ৪৭৮৮ নম্বর হাদীস মিসিং, অর্থাৎ ৪৭৮৭ এর পর সরাসরি ৪৭৮৯। তবে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডঃ মুহাম্মদ মুজিবর রহমানকে আমি এই কারণে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই যে তিনি ইবনে কাসিরের অনুবাদ করতে গিয়ে এই অসততাটুকুর আশ্রয় নেননি।

হাফসা সত্যিকার অর্থেই একজন বিদুষী রমণী ছিলেন। তিনিই নবীর স্ত্রীদের মধ্যে সর্বপ্রথম কুরআন মুখস্ত করেছিলেন এবং নবী মুহাম্মদের তিনজন হাফেজা স্ত্রীর একজন ছিলেন (অন্য দুইজন আয়িশা এবং উম্মে সালামা)। নবীর মৃত্যুর পর ইয়ামামার যুদ্ধে যখন  অনেক হাফিজ শহীদ হন তখন কুরআন লিখিত আকারে সংকলনের ভার জায়েদ  ইবনে সাবিতকে দেয়া হয়। সেই লিখিত প্রামাণ্য কপিটি ছিলো হাফসার কাছে। পরবর্তীতে খলিফা উসমান হাফসার কাছে থাকা সেই প্রামাণ্য কপি থেকে অনেকগুলো অনুলিপি তৈরি করেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণ করেন।

নবীর মৃত্যুর প্রায় আনুমানিক ৩২ বছর পর ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর কিংবা নভেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নবীর অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে জান্নাতুল বাকীতে এই তেজস্বী নারীকে সমাহিত করা হয় (৬৩) ।

হাফসাকে বিয়ে করার একমাসের মধ্যে নবী মুহাম্মদ আরোও একটি বিয়ে করেছিলেন। তিনি সুন্দরী হলেও হাফসা-আয়েশার মতো গ্লামারাস ছিলেন না। তিনি থাকতেন নিরবে-নিভৃতে। এরজন্য তাঁর সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তিনি আসছেন আগামী পর্বে !

তথ্যসূত্রঃ

(৫৪) ইবনে সাদ, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০৭, অষ্টম খন্ড পৃষ্ঠা ৫৬।

(৫৫) সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০০৫, ৫১২২, ৫১২৯, ৫১৪৫।

(৫৬) সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯১৩ এর একাংশ থেকে।

(৫৭) তাবারী, ৩৯তম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯৩-৯৫।

(৫৮) তাফসিরে ইবনে জারী, ইবনে কাছির তাফসীর, সূরা তাহরীম ১-৫, সুনানে নাসাই ৩৯৬১।

(৫৯) সূরা তাহরিম, আয়াত ১-৫।

(৬০) সূরা আহজাব, আয়াত ২৮, ২৯।

(৬১) সহীহ বুখারী ২৪৬৮, ৫১৯১, সহীহ মুসলিম ৩৫০৭ এর একাংশ,

সহীহ বুখারী (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৮০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮১২)।

(৬২) "Great Women of Islam" - by Dar-us-Salam Publications।

(৬৩) ইবনে সাদ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮।


জয়নব_বিনতে_খুজায়মাঃ

নবী মুহাম্মদের পঞ্চম স্ত্রী ছিলেন জয়নব বিনতে খুজায়মা। তাঁর প্রথম তেরজন পত্নী ও উপপত্নীদের মধ্যে আমরা সবচেয়ে কম জানি জয়নব বিনতে খুজায়মা সম্পর্কে। সীরাত গ্রন্থগুলোতে খুব সামান্যই তথ্য পাওয়া যায় এবং তথ্যগুলোও দ্বিমতে ভরপুর। তবে একটা জায়গায় সবাই একমত যে তিনি প্রচন্ড হাতখোলা ও দানশীল স্বভাবের ছিলেন।

তিনি ও তাঁর দ্বিতীয় স্বামী উবায়দা ইবনে আল হারিস প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন। উবাইদাই প্রথম মুসলিম যিনি কোন যুদ্ধে মারা যান (৬৪)। বদর যুদ্ধে তিনি ছিলেন একটি উপদলের সেনাপতি এবং তিনিই সবার আগে নিহত হন। বদর যুদ্ধের সবচেয়ে নিদারুণ বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধ হয়েছিলো নিকটাত্মীয়দের মধ্যে। ভাই অস্ত্র তুলেছে ভাইয়ের বিরুদ্ধে, কেউ চাচা বা মামার বিরুদ্ধে, কেউ বা ছোটবেলার বন্ধুর বিরুদ্ধে। বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে মক্কাবাসীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং মক্কাবাসীর মৃতের সংখ্যাও ছিলো পাঁচগুণ বেশি। জয়নব যখন তাঁর স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হন তখন তাঁর ঘরে ছিলো দশ সন্তান। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জয়নবের সেই সময়ের প্যাগান আত্মীয়রা মুসলিম জয়নবের উপর কোন অত্যাচার করে নি। উল্টো কাজিন কুবায়সা ইবনে আমর জয়নবকে মদিনায় পৌছাতে সাহায্য করেন। এমনকি তিনি এমন ব্যবস্থা করে দেন যেন জয়নব নিরাপদে মদিনা পৌছাতে পারে (৬৫ )।

প্রথম চার স্ত্রীর পর জয়নবই ছিলেন প্রথম স্ত্রী যিনি কুরাইশ গোত্রের বাইরে। তিনি ছিলেন মক্কার অন্যতম ধনী হিলাল গোত্রের মেয়ে (৬৬)। গোত্রের অন্যদের মতো জয়নবের পরিবারও ছিলো যথেষ্ট ধনী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নবী মুহাম্মদকে বিয়ে করার পরও জয়নবকে অর্থ পাঠানো বন্ধ হয়নি। বলা যায় জয়নবের জন্য তাঁর পরিবারের দুয়ার সবসময় খোলা ছিলো।

সম্ভবত পারিবারিক প্রভাবেই তিনি স্বভাবজাত দানশীল ছিলেন। তাঁর দানশীলতার জন্য তাঁকে উপাধি দেয়া হয়েছিলো উম আল মাসাকিন, অর্থাৎ দরিদ্রজননী (৬৭)। কথিত আছে, একদিন তাঁর কাছে এক দরিদ্র লোক সাহায্য চাইতে এসেছিলো।তাঁর ঘরে তখন ময়দা ছিলো।  তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে ঘরে থাকা সবটুকু ময়দা ঐ দরিদ্র লোকটিকে দান করে দেন। নবী মুহাম্মদ তাঁর এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে অন্য স্ত্রীদেরকে বললেন, “শিখো, তোমরা যদি আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, তাহলে আল্লাহই রিজিকের ব্যবস্থা করবেন, যেমন করে আল্লাহ পাখিদের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তারা সকালে ক্ষুধার্ত হয়ে নীড় থেকে বের হয়, রাতে ভরপেটে ঘরে ফেরে (৬৮)।“

তিনি বলতে গেলে নীরবে-নিভৃতেই ছিলেন। এরজন্য প্রথম তেরজন পত্নী-উপপত্নীর মধ্যে তিনিই একমাত্র যার নামের উল্লেখ কোন সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না (অন্তত আমি খুঁজে পাইনি) ।

বিয়ের মাত্র আটমাসের মাথায় ৬২৫ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবর মাসে (৬৯) কোন এক অজানা রোগে ভুগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সৌভাগ্যবান বলা হয় কারণ তিনি একমাত্র স্ত্রী যার জানাজার নামাজে নবী মুহাম্মদ ইমামতি করেন এবং নিজের হাতে দাফন করেন (খাদিজার সময় জানাজার নামাজ, এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রচলনই শুরু হয়নি)। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বাসঘর বেশ কিছু সময় খালি পরে থাকে। নবী মুহাম্মদের ষষ্ঠ স্ত্রী উম্মে সালামা এরপর এই ঘরে বসবাস শুরু করেন। তাঁর ভাষায় “তিনি (নবী মুহাম্মদ) আমাকে বিয়ে করেন এবং প্রয়াত দরিদ্রজননীর বাসঘরে তুলে নেন (৭০)।“

উম্মে সালামা ছিলেন সহজাত নেতৃত্বসুলভ গুনের অধিকারিণী। এমনকি একবার যখন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নবী-স্ত্রীদের মধ্যে গ্রুপিং হয়, দুই দলে ভাগ হয়ে যায়, তখন আয়েশা-হাফসার গ্রুপের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন যিনি, তিনি এই উম্মে সালামা। সে গল্পই আছে আগামী পর্বে !

তথ্যসূত্রঃ

(৬৪) ইবনে ইসহাক পৃষ্ঠা ৫০৬।

(৬৫) ইবনে হিশাম নোট ৯১৮ ।

(৬৬) ইবনে হিশাম নোট ৯১৮, তাবারী নবম খন্ড পৃষ্ঠা ১৩৮।

(৬৭) ইবনে হিশাম, লাইফ অফ প্রোফেট,  খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৮৩৩।

(৬৮) তিরমীযী, হাদীস নং ২৩৪৪।

(৬৯) ইবনে সাদ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮২।

(৭০) ইবনে হিশাম প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৫, দ্বিতীয় খন্ড ২৯৪, তাবারী ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ১৭৭।


হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া (উম্মে সালামা)ঃ
উম্মে সালামা ছিলেন কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত সম্ভ্রান্ত ও ধনী মাখজুম পরিবারের নারী। তাঁর স্বামীর নাম ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ। তিনি ছিলেন সালামার দুঃসম্পর্কের ভাই(৭১)। দুজনেই বেশ শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে প্রথমদিকে দুই পরিবার দুইজনকে আলাদা করে দেয় ও পরবর্তীতে তাঁদের পরিবার তাঁদের দুইজনকেই ত্যাজ্য করে (৭২)। পরিবার থেকে ত্যাজ্য হওয়ার পর তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিলো সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে মদিনায় হিজরত করার সময় তাঁদের সাথে নিজস্ব উট ছিলো এবং সেই উটই তাঁদের যাত্রার বাহন ছিলো(৭৩)।
উহুদের যুদ্ধের সময় আবদুল্লাহ মারাত্মকভাবে আহত হন, এবং সেই জখম থেকেই ৬২৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (৭৪)। স্বামীর মুমূর্ষু অবস্থায় হিন্দ মানসিকভাবে বেশ ভেংগে পড়েন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে জীবনে কখন বিয়ে করবেন না। কেননা তিনি চেয়েছিলেন, ইহকালে অকালে স্বামীকে হারালেও পরকালে অনন্তকালের জন্য যেন স্বামীর সাহচর্যে থাকতে পারেন। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী আবদুল্লাহ তাঁকে এরকম প্রতিজ্ঞা করতে নিষেধ করেন । কেননা, তখনো তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ যুবতী (৭৫)। তিনি স্বামীকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এজন্য সদ্য স্বামীকে হারানোর শোকে তিনি বিলাপ করে কাঁদছিলেন। বিলাপ করে কাঁদতে দেখে নবী মুহাম্মদ তাঁকে কাঁদতে নিষেধ করেন এবং মৃতের জন্য কান্নাকাটির কুফল বর্ণনা করেন। স্বয়ং উম্মে সালামার বর্ণনায় ঃ
“তিনি বলেন, যখন আবূ সালামাহ্‌ (রাঃ) ইনতিকাল করলেন আমি (আক্ষেপ করলাম) বললাম, আহ! নির্বাসিত ব্যক্তি! আহ! বিদেশ ভূমিতে মারা গেল! আমি তাঁর জন্য এমনভাবে (বুক ফাটিয়ে) কান্নাকাটি করব যা মানুষের মাঝে চর্চা হতে থাকবে। আমি কান্নার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় একজন মহিলা আমাকে সঙ্গ দেয়ার মনোভাব নিয়ে মাদীনায় উঁচু এলাকা থেকে আসলেন এমন সময় রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সামনে এগিয়ে এসে বললেনঃ আরে! তুমি কি শাইত্বনকে ঐ ঘরে ঢুকাতে চাচ্ছ যেখান থেকে মহান আল্লাহ তাকে দু’বার তাড়িয়ে দিয়েছেন? (উম্মু সালামাহ্‌ বলেন) এ কথা শুনামাত্র আমি কান্না বন্ধ করলাম এবং আর কাঁদলাম না (৭৬)।“
আবদুল্লাহ যখন মারা যান তখন হিন্দ ছিলেন সন্তান-সম্ভবা (৭৭) । সুতরাং তাঁর ইদ্দতকাল স্বাভাবিকভাবেই বেশ দীর্ঘ ছিলো। ৬২৬ সালের মার্চ মাসের দিকে তিনি ইদ্দতকাল পার করেন এবং পুনরায় বিয়ের উপযুক্ত হন (৭৮)। সৌন্দর্য, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচক্ষণতায় তিনি ছিলেন অনন্য। এ যুগের ভাষায় বললে, “বিউটি উইথ দ্য ব্রেইন।” এই কারণেই ইদ্দতকাল পার হওয়ার সাথে সাথে চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয় এবং তিনিও একে একে সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন। নবীর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান আবু বকর। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর নিজের জন্য প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন উমর। তিনি উমরকেও ফিরিয়ে দেন। এরপর নবী মুহাম্মদ যখন নিজের জন্য হিন্দকে পছন্দ করলেন তখন অন্য সাহাবীরা প্রস্তাব পাঠানো বন্ধ করে দেন। কিন্তু হিন্দ তাঁর বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অটল থেকে নবী মুহাম্মদের প্রস্তাবও বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে দেন। এরপর মুহাম্মদ স্বয়ং হিন্দের বাড়িতে হাজির হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন হিন্দ আবারো প্রত্যাখান করেন (৭৯)। মুহাম্মদ তাঁকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং বিমর্ষ হৃদয়ে ফেরত যান। এর অল্প কিছুদিন পরে মুহাম্মদ পুনরায় হাজির হন এবং কেন বিয়েতে রাজি না জিজ্ঞেস করেন। তখন হিন্দ বিভিন্ন কারণ বলেন, যেমন তাঁর বয়স বেশি (প্রায় ৩০ বছর), চার ছেলে মেয়ে আছে (সালামা, উমর, জয়নব ও রুকাইয়া), তাছাড়া এতোজন স্ত্রী থাকলে একজন অন্যজনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পারেন। মুহাম্মদ প্রত্যেকটি যুক্তি খন্ডন করেন এইভাবে যে তাঁর নিজের বয়স হিন্দের তুলনায় অনেক বেশি, আর হিন্দের সন্তান মানে তাঁর নিজেরও সন্তান এবং ঈর্ষা কমানোর জন্য তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন। অবশেষে হিন্দ বিয়ে করতে রাজি হন এবং ৬২৬ সালের ৬ই এপ্রিল, ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার উনিশ দিনের মাথায় নবী মুহাম্মদ ও হিন্দের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয় (৭৮)।
আয়িশা, হাফসার পরে তিনি তৃতীয় স্ত্রী যিনি কুরানের হাফেজা ছিলেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। এইজন্যই তাঁর সাথে হাফসা-আয়িশার প্রায়ই স্নায়ুযুদ্ধ চলতো। তিনি আয়িশার প্রতি নবীর পক্ষপাতিত্বে বেশ ক্ষুদ্ধ ছিলেন। এবং এই পক্ষপাতিত্ব নিয়েই একপর্যায়ে নবী স্ত্রীগণ দু’দলে ভাগ হয়ে যান। এই বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করলে নবী উত্তর দেন, আয়িশাই একমাত্র স্ত্রী, যার সাথে সংগমরত অবস্থায় ওহী নাজিল হয়েছিলো। পুরো ঘটনাটি সরাসরিই হাদীস থেকে দেখে নিই।
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণ দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। একদলে ছিলেন ‘আয়িশা, হাফসাহ, সাফিয়্যাহ ও সাওদা (রাযিয়াল্লাহু আনহুন্না), অপর দলে ছিলেন উম্মু সালামা (রাঃ) সহ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণ। ‘আয়িশা (রাঃ)-এর প্রতি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিশেষ ভালবাসার কথা সাহাবীগণ জানতেন। তাই তাঁদের মধ্যে কেউ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট হাদিয়া পাঠাতে চাইলে তা বিলম্বিত করতেন। যে দিন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশা (রাঃ)-এর ঘরে অবস্থান করতেন, সেদিন হাদিয়া দাতা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ‘আয়িশা (রাঃ) -কে তাঁরা পাঠিয়ে দিতেন। উম্মু সালামা (রাঃ)-এর দল তা নিয়ে আলোচনা করলেন। উম্মু সালামা (রাঃ) -কে তাঁরা বললেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে আপনি আলাপ করুন। তিনি যেন লোকদের বলে দেন যে, যারা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট হাদিয়া পাঠাতে চান, তাঁরা যেন তাঁর নিকট পাঠিয়ে দেন, যে স্ত্রীর ঘরেই তিনি থাকুন না কেন। উম্মু সালামা (রাঃ) তাঁদের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে কোন জবাব দিলেন না। পরে সবাই তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তিনি আমাকে কোন জবাব দিলেন না। তখন তাঁরা তাঁকে বললেন, আপনি তাঁর সঙ্গে আবার কথা বলুন। (‘আয়িশা) বলেন, যেদিন তিনি [রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] -তাঁর (উম্মু সালামার’র) ঘরে গেলেন, সেদিন তিনি আবার তাঁর নিকট কথা তুললেন। সেদিনও তিনি তাঁকে কিছু বললেন না। অতঃপর তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি বললেন, আমাকে তিনি কিছুই বলেননি। তখন তাঁরা তাঁকে বললেন, তিনি কোন জবাব না দেয়া পর্যন্ত আপনি বলতে থাকুন। তিনি [নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] তাঁর ঘরে গেলে আবার তিনি তাঁর নিকট সে প্রসঙ্গ তুললেন। এবার তিনি তাঁকে বললেন, ‘আয়িশা (রাঃ)-এর ব্যাপার নিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। মনে রেখ, ‘আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত আর কোন স্ত্রীর বস্ত্র তুলে থাকা অবস্থায় আমার উপর ওয়াহী নাযিল হয়নি। [‘আয়িশা (রাঃ)] বললেন, এ কথা শুনে তিনি [উম্মু সালামা (রাঃ)] বললেন, সে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে কষ্ট দেয়া হতে আমি আল্লাহর নিকট তওবা করছি। অতঃপর সকলে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যা ফাতিমা (রাঃ) -কে এনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এ কথা বলার জন্য পাঠালেন যে, আপনার স্ত্রীগণ আল্লাহর দোহাই দিয়ে আবূ বকর (রাঃ)-এর কন্যা সম্পর্কে ইনসাফের আবেদন জানালেন। [ফাতিমা (রাঃ)] তাঁর নিকট বিষয়টি তুলে ধরলেন। তখন তিনি বললেন, প্রিয় কন্যা! আমি যা ভালবাসি তুমি কি তাই ভালবাস না? তিনি বললেন অবশ্যই করি। অতঃপর তাদের নিকট গিয়ে তাদেরকে (আদ্যোপান্ত) অবহিত করলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, তুমি আবার যাও। কিন্তু এবার তিনি যেতে অস্বীকার করলেন। তখন তাঁরা যায়নাব বিন্তু জাহশ (রাঃ) -কে পাঠালেন। তিনি তাঁর নিকট গিয়ে কঠোর ভাষা ব্যবহার করলেন এবং বললেন, আপনার স্ত্রীগণ আল্লাহর দোহাই দিয়ে ইবনু আবূ কুহাফার [আবূ বকর (রাঃ)] কন্যা সম্পর্কে ইনসাফের আবেদন জানাচ্ছেন। অতঃপর তিনি গলার স্বর উঁচু করলেন। এমনকি ‘আয়িশা (রাঃ) -কে জড়িয়েও কিছু বললেন। ‘আয়িশা (রাঃ) সেখানে বসা ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশা (রাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। তিনি কিছু বলেন কিনা।
রাবী ‘উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, ‘আয়িশা (রাঃ) যায়নাব (রাঃ)-এর কথার প্রস্তুতি বাদে কথা বলতে শুরু করলেন এবং তাঁকে চুপ করে দিলেন। ‘আয়িশা (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন ‘আয়িশা (রাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ হচ্ছে আবূ বক্‌রের (রাঃ) কন্যা। আবূ মারওয়ান গাস্‌সানী (রাঃ) হিশাম এর সূত্রে ‘উরওয়াহ (রাঃ) হতে বলেন, লোকেরা তাদের হাদিয়াসমূহ নিয়ে ‘আয়িশা (রাঃ)-এর জন্য নির্ধারিত দিনের অপেক্ষা করত। অন্য সনদে হিশাম (রহঃ) মুহাম্মাদ ইবনু ‘আবদুর রহমান ইবনু হারিস ইবনু হিশাম (রহঃ) হতে বর্ণিত। ‘আয়িশা (রাঃ), বলেছেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ছিলাম, এমন সময় ফাতিমাহ (রাঃ) অনুমতি চাইলেন (৮০)।
কুরআনে পুরুষদের বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব উম্মে সালামারও চোখে পড়েছিলো। তিনি একদিন সরাসরি নবী মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা কুরআনে পুরুষদের কথা এতো বেশি লেখা আছে কিন্তু নারীদের কথা কোথাও লেখা নেই কেন?” নবী কোন কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলেন। ঠিক তার পরেই একদিন বিকেলে সালামা তাঁর ঘরে বসে আনমনে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি নবী মুহাম্মদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। তিনি মিম্বরে বসে উচ্চস্বরে পাঠ করছিলেন সদ্য নাজিল হওয়া সূরা আহজাবের ৩৫ নম্বর আয়াত (৮১),
“নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ ও ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ ও অধিক যিকিরকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার(৮২)।”
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায় হুদাইবিয়ার ঘটনায়। প্রাসংগিকভাবে হুদাইবিয়ার প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন।
বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে মক্কাবাসীর সংগে মুসলিমদের সংঘাত তখন চরমে। এরমধ্যে নবী মুহাম্মদ একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি কাবা ঘরের চাবি হাতে পেয়েছেন, মাথার চুল কামিয়েছেন, কাবাঘরে প্রবেশ করেছেন এবং আরাফাতের ময়দানে বিরতি নিয়েছেন। নবীর স্বপ্ন যেহেতু মিথ্যা হতে পারেনা, তাই তিনি সাহাবীদের এই সুসংবাদ দিলেন এবং প্রায় চৌদ্দশ অনুসারী নিয়ে ওমরাহ পালন করার জন্য রওনা দিলেন। বদর, ওহুদ, খন্দক ইত্যাদি নানা যুদ্ধের পর মক্কাবাসী চরম সতর্ক। যে করেই হোক মুসলিমদের মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না।
মুসলিম আর মক্কাবাসী দু’পক্ষই দূতের মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা করার চেষ্টা করেন। এতে কাজ না হওয়ায়, বিশিষ্ট কুরাইশ নেতা উরওয়া ইবনে মাস’উদ আসেন সন্ধি স্থাপনের জন্য। তিনি নবীকে বলেন,“আপনি কি চান আপনার আপন গোত্রকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে? আর যদি ফলাফল অন্যরকম হয়, তখন আপনার দলে অনেকেই আছে আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে, তখন আপনার অবস্থা কিরকম হবে?” তখন আবু বকর খেপে গিয়ে বলেন, “আমরা মোটেও পালাবো না, তোমরা বরঞ্চ লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও।” আবুবকর এ কথা বলার পরেই তীব্র বাকবিতন্ডা শুরু হলো এবং উরওয়া ফিরে গেলেন। এরপর নবীর আত্মীয় সুহায়েল ইবনে আমর আসলেন। তখন নবী সাহাবীদেরকে বললেন, “এবার তোমাদের জন্য কাজ সহজ হয়ে গেলো। সুহায়েল তখন শান্তি চুক্তিপত্র লেখার প্রস্তাব দিলেন। তখন নবী চুক্তির শুরুতে লিখতে বললেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”, শুনে সুহায়েল বললেন, “রহিম-রহমান কে? আমরা কোন রহিম রহমানকে চিনি না, আপনি আগে যেভাবে লিখতেন ঠিক সেভাবেই লিখুন। “বস্তুত আগে কুরাইশরাও চুক্তির শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখতেন। একথা শুনে সাহাবীরা ভীষণ খেপে গেলেও নবী সম্মত হলেন।
এরপর কারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, লেখার সময় নবী “মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ” লিখতে বললেন। তখন সুহাইল বললেন, “আল্লাহর কসম! আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রসূল বলেই বিশ্বাস করতাম, তাহলে আপনাকে কা‘বা যিয়ারত থেকে বাধা দিতাম না এবং আপনাদের সাথে যুদ্ধ করতে উদ্যত হতাম না। বরং আপনি লিখুন, ‘আবদুল্লাহ্‌র পুত্র মুহাম্মদ।“ নবী মুহাম্মদ বাধ্য হয়েই মেনে নিলেন। এবং চুক্তিপত্রে তাঁর নামের যায়গায় লেখা হলো, “মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ, অর্থাৎ আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। এরপর নিম্নলিখিত শর্তের ভিত্তিতে চুক্তি সাক্ষরিত হলো,
(১) মুসলমানগণ এ বছর উমরাহ না করেই মদীনায় ফিরে যাবে।
(২) আগামী বছর উমরার জন্য এসে তারা তিন দিন মক্কায় অবস্থান করতে পারবে এবং তাদের অবস্থানকালে কুরাইশরা মক্কা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে।
(৩) কুরাইশদের এবং মুসলমানদের মধ্যে আগামী দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।
(৪) কুরাইশদের কেউ মদীনায় আশ্রয় নিলে তাকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু মদীনার কোন মুসলমান মক্কায় আশ্রয় নিলে, তাকে ফেরত দেয়া হবে না।
(৫) আরবের যেকোন গোত্রের লোক মুসলমানদের বা কুরাইশদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে।
(৬) মক্কায় ব্যবসায়ীরা নিরাপদে মদীনার পথ ধরে সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশে ব্যবসা করতে পারবে।
(7) মক্কায় বসবাসকারী মুসলিমদের জান মালের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
(8) চুক্তিতে স্বাক্ষর কারী পক্ষদ্বয় একে অপরেরে সম্পদকে সম্মান করবে।
(9) মক্কায় প্রবেশকালে মুসলিমরা বর্শা বা ফলা আনতে পারবে না। আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তলোয়ার আনতে পারবে।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরে সাহাবীরা প্রচন্ড হতাশ ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন।
কারণ চুক্তির পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিলো মুসলিমদের জন্য ভীষণ অবমাননাকর। সবাই এই আশা নিয়ে এসেছিলেন যে যেহেতু নবী স্বপ্নে দেখেছেন সেহেতু বিজয় তাঁদের হবেই। কিন্তু তাঁরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখেন ঠিক তাঁর বিপরীত ঘটনাই ঘটছে। এতে উমর সহ অনেকেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তখন উমর প্রশ্ন করেন, “হে নবী, আপনি কি বলেননি যে আপনি কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন, কাবাঘরের চাবি হস্তগত করবেন এবং আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করবেন? অথচ, না আমরা কাবায় গেলাম, না আমাদের পশুগুলো কাবা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো।“ নবী তখন উত্তর দিলেন, “আমি কি বলেছিলাম এই বছরই তা করবো?”উত্তরে উমর বললেন, “না” । তখন নবী বললেন, “নিশ্চয়ই আমরা একদিন কাবায় প্রবেশ করবো এবং আমার স্বপ্ন সত্যি হবে!” উমর তখন আবু বকরের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তিনি কি সত্যি আল্লাহর নবী নন? যদি সত্যিই হন তাহলে আমরা কেন এতো অপমানিত হলাম?” আবু বকর সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “ধৈর্য ধরো উমর, আল্লাহর রসুল যখন বলেছেন তখন বিজয় আমাদের হবেই। “
হুদাইবিয়ার চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পরে সেবার আর মক্কা প্রবেশের আর কোন উপায় রইলো না। হুদাইবিয়ার প্রান্তরে তখন নবী সবাইকে বললেন, “তোমরা এইখানেই মাথা কামাও এবং কুরবানী দাও।“ তিনি পরপর তিনবার আহবান করার পরেও কেউ উঠে দাঁড়ায় না। তীব্র হতাশা ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নবী বিমর্ষমুখে উম্মে সালামার তাঁবুতে প্রবেশ করেন, এবং উম্মে সালামার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতাতেই তিনি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পান।
নবী উম্মে সালামাকে সবকিছু খুলে বলেন। সব শুনে উম্মে সালামা একটি বুদ্ধি দেন। তিনি পরামর্শ দেন যে আপনি একটি কাজ করুন, বাইরে গিয়ে কারও সাথে কথা বলবেন না, চুপচাপ নিজের চুল কামিয়ে নিজে নিজেই কুরবানী দেন। এরপর সত্যি সত্যি কারো সাথে কথা না বলে তিনি একজনকে ডেকে মাথা কামিয়ে নিলেন এবং চুপচাপ নিজের ভাগের উট কুরবানী দিয়ে দিলেন। এরপর তাঁর দেখাদেখি একজন দুইজন করে সবাই মাথা কামাতে লাগলেন, এবং কুরবানী দিতে লাগলেন (৮৩)। এরপরে তাঁরা যখন মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন , তখন মাঝ রাস্তায় নাজিল হলো ২৯ আয়াত সম্বলিত সূরা ফাতহ। যেখানে আল্লাহ নিজে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজয় তোমাদের সুনিশ্চিত (৮৪)!
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পরও সাহাবীরা তাঁর কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন। আয়িশার মতো তিনিও শিক্ষকতা করতেন এবং তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন(৮৫)।
মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদের শাসনামলে, কারবালার ঘটনার সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন। নবীর মৃত্যু-পরবর্তী বিভিন্ন কলহের মধ্যে তিনি সবসময় আহলে বায়াত, অর্থাৎ আলি-ফাতেমা ও তাঁর পরিবারকে সাপোর্ট করে গেছেন। নবীর সবচেয়ে প্রিয় কন্যা ফাতেমাকে পেলে-পুষে বড় করেছেন তিনিই। এমনকি “ভার্স অফ পিউরিফিকেশন (৮৬)” অর্থাৎ যেখানে নবীর বংশধরকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত করা হয়, সেই আয়াতও তাঁর ঘরে নাজিল হয় (৮৭)। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলি ফাতিমার পরিবারকে সাপোর্ট করে গিয়েছেন। বিশেষ করে জংগে জামাল বা উটের যুদ্ধে তিনি সরাসরি আয়িশার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং সবাইকে নবীর কাছে আলি ফাতেমার অবস্থান মনে করিয়ে দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজের ছেলে উমরকেও আয়িশার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। এসব কারনে তিনি শিয়াদের কাছে বিশেষ সম্মানিত এবং শিয়ারা খাদিজার পরে তাঁকেই সবচেয়ে সম্মানিত স্ত্রী হিসেবে অবিহিত করেন। তিনি দীর্ঘজীবী ছিলেন। সম্ভবত তিনিই সর্বশেষ স্ত্রী হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন।
আয়েশা-হাফসার মতো এতো অন্তরংগ না হলেও, হিন্দ ওরফে উম্মে সালামার সাথে বিশেষ খাতির ছিলো আরেক স্ত্রী জয়নব বিনতে জাহশের, যার গল্পের জন্য অনেকেই অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করে আছেন। নবী মুহাম্মদের সপ্তম স্ত্রী জয়নব বিনতে জাহশ আসছেন আগামী পর্বে !

তথ্যসুত্রঃ
(৭১) তাবারী, নবম খন্ড( দ্য লাস্ট ইয়ার অফ প্রফেট), পৃষ্ঠা ১৩২।
(৭২) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ১৬৯-৭০।
(৭৩) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ২১৩-১৪।
(৭৪) তাবারী, ৩৯তম খন্ড(বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস ), পৃষ্ঠা ১৭৫, ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৬১।
(৭৫) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৬২।
(৭৬)সহীহ মুসলিম ২০১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০১০।
(৭৭) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৬৬।
(৭৮) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৬১।
(৭৯) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৬৩।
(৮০) সহীহ বুখারী ২৫৮১।
(৮১) সূরা আহজাব, আয়াত ৩৫ এর তাফসীর, ইবনে জারী, ইবনে কাসির।
(৮২) সূরা আহজাব, আয়াত ৩৫।
(৮৩) সহীহ বুখারী ২৭৩১, চ্যাপ্টার ৫৪ (শর্তাবলী, হাদীস ২৭১১-৩৭) পড়লেই এই সম্পর্কিত ঘটনা ডিটেইলসে জানা যায়।
(৮৪) সুরাহ ফাতহ তাফসীর, ইবনে কাসির, ইবনে জারী।
(৮৫) লাইলা আহমেদ, উইমেন এন্ড জেন্ডার ইন ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬১।
(৮৬) সূরা আহজাব, আয়াত ৩৩।
(৮৭) সূরা আহজাব আয়াত ৩৩ এর তাফসীর, ইবনে কাসির, ইবনে জারী।

জয়নব বিনতে জাহশঃ

জয়নব বিনতে জাহশ, নবী মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে আরেক উজ্জ্বল চরিত্র। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর আপন ফুফাতো বোন । জয়নবের আরেকটি বিশেষ গুণ ছিলো, তিনি ছিলেন দক্ষ সূচীশিল্পী। তিনি চামড়া ও উলের চমৎকার কাজ জানতেন এবং সুন্দর পোশাক বানাতে পারতেন (৮৮)। তাঁর প্রথম স্বামীর নাম জানা যায়না। তিনি ছিলেন প্রথমদিকের ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন এবং অন্য অনেকের সাথে তিনিও মদিনায় হিজরত করেন (৮৯)।
জয়নব বিনতে জাহশের সাথে অবধারিতভাবেই যে নামটি এসে যায় সেই নামটি হচ্ছে জায়েদ ইবনে হারিসা ওরফে জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ। জায়েদ ছিলেন বনু কালব গোত্রের এবং খুব ছোট বয়সে দাস বিক্রেতাদের হাতে অপহৃত হন। খাদিজার ভাতিজা হাকিম ইবনে হিজাম জায়েদকে কিনে নেন এবং খাদিজাকে উপহার দেন। খাদিজার বিয়ের সময় জায়েদকে বিয়ের উপহার হিসেবে স্বামী মুহাম্মদকে দিয়ে দেন। মুহাম্মদ জায়েদকে খুবই পছন্দ করেন এবং নাম দেন আল হাবীব ( Beloved বা প্রিয়)। তিনি জায়েদকে খুবই ভালোবাসতেন, দাস হলেও নিজের ছেলের মতো ব্যবহার করতেন। এর কয়েকবছর পর জায়েদের পরিবার হজ্জ করার জন্য মক্কা আসেন এবং ঘটনাচক্রে জায়েদের সাথে দেখা হয়ে যায়। তাঁরা তখন মোটা অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে জায়েদকে মুক্তি দিতে অনুরোধ করেন। উত্তরে মুহাম্মদ বলেন, সবকিছুই নির্ভর করছে জায়েদের উপরে। জায়েদ যদি ফিরে যেতে চায় তাহলে কোন মুক্তিপণ লাগবে না, এমনিতেই যেতে দিবেন। তখন জায়েদ অস্বীকৃতি জানান, কারণ তিনিও মুহাম্মদকে ভীষণ পছন্দ করতেন। ঠিক সেই সময় মুহাম্মদ সিদ্ধান্ত নেন জায়েদকে মুক্তি দিবেন এবং পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন। সেই সময় পালকপুত্র গ্রহণ করার বিশেষ রীতি ছিলো যে কাবাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জনসম্মুখে প্রতিজ্ঞা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পালকপুত্র সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে পূর্ণ অধিকার প্রাপ্ত হবেন। জায়েদকে গ্রহণ করার পর জায়েদের নতুন নাম হলো জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ এবং জায়েদের বাবা ও চাচা তখন সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে যান(৮৯)।
খাদিজার ইসলাম গ্রহণের পরপরই জায়েদ ইসলাম গ্রহণ করেন। এর সাথে একটি বিশেষ ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়। নবুয়ত লাভের কিছুদিন পূর্বে মুহাম্মদ জায়েদকে সংগে নিয়ে তায়েফ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। তখন তায়েফে একটি প্রথা ছিলো যে দেবতার মূর্তির কাছে পশু উৎসর্গ করা হতো। সেই মাংস একটি ব্যাগে করে কাঁধে নিয়ে জায়েদ মুহাম্মদের সাথে মক্কা ফিরে আসছিলেন। ফেরার পথে তাঁদের সাথে জায়েদ ইবনে আমরের সাথে দেখা হয়, যিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী । জায়েদ তখন আমরকে কিছু রান্না করা মাংস সাধেন, এবং আমর তখন খেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন এক আল্লাহ ছাড়া কারো নামে উৎসর্গকৃত মাংস আমি খাইনা। এই কথাটি নবী মুহাম্মদকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এরপর তিনিও কখনো দেবতার নামে কোন পশু উৎসর্গ করেন নি বা খাননি (৯০)।
তবে এই ঘটনাটিই সহীহ বুখারীতে একটু অন্যরকমভাবে লেখা আছে। ইমাম বুখারীর মতে নবী মুহাম্মদও সেই মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। প্রাসংগিকভাবে আরেকটি কথা পাঠকদের জানা প্রয়োজন। ইবনে ইশাকের গ্রন্থ সিরাত রাসুলুল্লাহ নবী মুহাম্মদের জীবনীগ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। ইশাক জন্মগ্রহণ করেছেন নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর মাত্র ৭৪ বছর পর, অপরদিকে বুখারী জন্মেছেন ১৮০ বছর পর। চলুন দেখে নিই বুখারীর হাদীসে ঠিক কি লেখা আছে,
আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
যে, ওয়াহী নাযিল হওয়ার পূর্বে একবার নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার নিম্ন অঞ্চলের বালদাহ নামক জায়গায় যায়দ ইব্‌নু ‘আমর ইব্‌নু নুফায়লের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর সামনে খাদ্য পূর্ণ একটি ‘খানচা’ পেশ করা হল। তিনি তা হতে কিছু খেতে অস্বীকার করলেন। এরপর যায়দ (রাঃ) বললেন, আমিও ঐ সব জন্তুর গোশ্‌ত খাই না যা তোমরা তোমাদের দেব-দেবীর নামে যবেহ কর। আল্লাহ্‌র নামে যবেহকৃত ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করা জন্তুর গোশ্‌ত আমি কিছুতেই খাই না। যায়দ ইব্‌নু ‘আমর কুরাইশের যবেহকৃত জন্তু সম্পর্কে তাদের উপর দোষারোপ করতেন এবং বলতেন; বকরীকে সৃষ্টি করলেন আল্লাহ্‌, তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আকাশ হতে বারি বর্ষণ করলেন। ভূমি হতে উৎপন্ন করলেন তৃণ-লতা অথচ তোমরা আল্লাহ্‌ তা‘আলার সমূহদান অস্বীকার করে প্রতিমার প্রতি সম্মান করে আল্লাহ্‌র নাম ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করছ (৯১)।
জায়েদ থেকে আবার জয়নবে ফিরে আসি। আনুমানিক ৬২৫ সালের দিকে জায়েদের ব্যাপারে জয়নব বিনতে জাহশকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জয়নব সরাসরি অস্বীকার করেন এই বলে যে তিনি কুরাইশ বংশের মেয়ে হয়ে একজন আজাদকৃত দাসকে বিয়ে করতে পারবেন না (৯২) । তখন নবী মুহাম্মদ জয়নবকে স্মরণ করিয়ে দেন যে আল্লাহর চোখে সবাই সমান। তখন জয়নব বললেন, “আমাকে একটু সময় দেন, আমি একটু চিন্তা করে দেখি,” ঠিক তখনই একটি সূরা আহজাবের ৩৬ নম্বর আয়াত নাজিল হয়ে গেলো (৯৩),
"আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন (কিছু করার) ক্ষমতা নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়(৯৪)।”
এই আয়াত নাজিল হওয়ার পরে জয়নব সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান এবং জায়েদকে বিয়ে করেন। ইসলামিক স্কলারদের ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহর চোখে যে সবাই সমান, এর দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের জন্য এই বিয়ে জরুরী ছিলো।
তাঁদের বিয়ে দুই বছরেরও কম সময় টিকে ছিলো। ইবনে সা’দ ও তাবারীর বর্ণনানুসারে, একদিন নবী মুহাম্মদ জায়েদের সাথে দেখা করার জন্য জায়েদের বাড়ি যান। ঘটনাচক্রে জায়েদ সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। দুর্ঘটনাক্রমে বাড়ির দরজার পর্দা সরে যায় এবং তিনি সল্পবসনা জয়নবকে দেখে ফেলেন। অপ্রস্তুত জয়নব তখন নিজেকে জামাকাপড়ে আবৃত করেন এবং মুহাম্মদকে ভেতরে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে বলেন। মুহাম্মদ এই অবস্থায় জয়নবকে দেখে হতচকিত হয়ে যান, এবং বলে উঠেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি হৃদয়কে পরিবর্তন করে দেন। এরপর ভিতরে প্রবেশ না করেই দ্রুতবেগে নিজের বাড়িতে চলে আসেন (৯৫)।
জায়েদ বাড়িতে আসলে জয়নব জায়েদকে সবকিছু খুলে বলেন। জায়েদ শুনেই নবীর বাড়িতে ছুটে যান। তখন জায়েদ নবীকে বলেন, “আমি সবকিছুই শুনেছি। আপনি সম্ভবত জয়নবকে পছন্দ করেন। আপনি যদি চান, আমি জয়নবকে তালাক দিতে পারি। উত্তরে নবী বলেন, “তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই রাখো (৯৬)।
অবশ্য আধুনিক স্কলাররা এই বিষয়টি অস্বীকার করেন যে নবী মুহাম্মদ জয়নবের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জয়নবকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। তাঁরা এই যুক্তি পেশ করেন যে, তিনি ভিতরে না ঢুকে ফেরত এসেছেন। আর তিনি জয়নবের জন্য পাগল হয়েছেন এটা জায়েদের একান্তই নিজস্ব ধারণা। তাছাড়া সত্যিই যদি তিনি পাগল হতেন তাহলে জায়েদকে বিয়ে না দিয়ে নিজেই বিয়ে করতেন, কেননা তিনি জয়নবকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন। আগ্রহীরা প্রখ্যাত স্কলার ডঃ ইয়াসির কাদরির এই ভিডিওটি দেখতে পারেন (৯৭)।
এর পরেই জায়েদ এবং জয়নবের ঝগড়া হয়। জয়নব জায়েদকে শয়নকক্ষ থেকে বের করে দেন। ৬২৬ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জায়েদ জয়নবের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে (৯৮)। এদিকে জায়েদকে ফেরত পাঠানোর কিছুদিন পরেই সূরা আহজাবের ৩৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়,
আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে (৯৯)।
এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর বিয়ে করতে আর কোন বাঁধা রইলো না। জয়নবের ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ৬২৭ সালের ২৭ মার্চ তিনি বিয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে জয়নবের বাড়ি যান । জয়নব নবীকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হন। তিনি জিজ্ঞেস করেন আমাদের বিয়ের কোন সাক্ষী থাকবে না? তিনি উত্তর দেন , বিয়ের সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ এবং ফেরেশতা জিব্রাইল। অতঃপর তাঁদের শুভবিবাহ সম্পন্ন হয় (৯৮)।
তাফসীরকারক প্রায় সকলেই এই বিয়ের বিশেষ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের ভাষায়, ঐ সময়ে আরবে একটা কুসংস্কার প্রচলিত ছিলো যে পালকপুত্র মানে নিজের পুত্র, এবং পালকপুত্রের সাবেক স্ত্রীকে বিয়ে করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এই কুসংস্কার দূর করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ স্বয়ং রসুলের নিজ পুত্রবধুর সংগে রাসুলের বিয়ে দিয়ে দেন। এরফলে সন্তান দত্তক নেয়ার প্রাচীন রীতি ইসলামে রহিত হয়ে যায় এবং জায়েদ বিন মুহাম্মদের নাম পুনরায় জায়েদ বিন হারিসায় পরিবর্তিত হয় (৮৯)। এই প্রসঙ্গে সূরা আহজাবে যে আয়াতটি নাজিল হয় সেটি হচ্ছে,
“আল্লাহ কোন মানুষের মধ্যে দুটি হৃদয় স্থাপন করেননি। তোমাদের স্ত্রীগণ যাদের সাথে তোমরা যিহার কর, তাদেরকে তোমাদের জননী করেননি এবং তোমাদের পোষ্যপুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ ন্যায় কথা বলেন এবং পথ প্রদর্শন করেন (১০০) ।“
বলা হয়ে থাকে জয়নবের বিয়ের প্রীতিভোজ ছিলো তাঁর বিয়ের মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ। আমরা সাওদার পর্বে, সাওদার একটি ঘটনা নিয়ে সূরা আহজাবের ৫৯ নম্বর আয়াত নাজিল হওয়ার ঘটনা জেনেছি (পর্দার আয়াত)। জয়নবের বিয়ের প্রীতিভোজেও এরকম একটি পর্দার আয়াত নাজিল হয়। এই প্রসঙ্গে অনেকগুলো হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এরমধ্যে একটি হাদীস দেখে নিই,
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
যায়নাব বিনতে জাহশের সাথে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাসর যাপন উপলক্ষে কিছু গোশত ও রুটির ব্যবস্থা করা হল। তারপর খানা খাওয়ানোর জন্য আমাকে লোকদের ডেকে আনতে পাঠালেন। একদল লোক এসে খেয়ে চলে গেল। তারপর আর একদল এসে খেয়ে চলে গেল। এরপর আবার আমি ডাকতে গেলাম, কিন্তু কাউকে আর ডেকে পেলাম না। আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আর কাউকে ডেকে পাচ্ছি না। তিনি বললেন, খানা উঠিয়ে নাও। তখন তিন ব্যক্তি ঘরে রয়ে গেল, তারা কথাবার্তা বলছিল। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বের হয়ে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর ঘরের দিকে গেলেন এবং বললেন, আস্সালামু ‘আলায়কুম ইয়া আহলাল বায়ত ওয়া রহমাতুল্লাহ্! ‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেন, ওয়া আলায়কাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। আল্লাহ্ আপনাকে বারাকাত দিন, আপনার স্ত্রীকে কেমন পেলেন? এভাবে তিনি পর্যায়ক্রমে সব স্ত্রীর ঘরে গেলেন এবং ‘আয়িশাহ্কে যেমন বলেছিলেন তাদেরও তেমনি বললেন। আর তাঁরা তাঁকে সে জবাবই দিয়েছিলেন, যেমন ‘আয়িশাহ (রাঃ) দিয়েছিলেন। তারপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফিরে এসে সে তিন ব্যক্তিকেই ঘরে কথাবার্তা বলতে দেখতে পেলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খুব লাজুক ছিলেন। (লজ্জা পেয়ে) আবার ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর ঘরের দিকে গেলেন। তখন, আমি স্মরণ করতে পারছি না, অন্য কেউ না আমি তঁ াকে লোকদের বের হয়ে যাওয়ার খবর দিলাম। তিনি ফিরে এসে দরজার চৌকাঠের ভিতরে এক পা ও বাইরে এক পা রেখে আমার ও তাঁর মধ্যে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা পর্দার আয়াত অবতীর্ণ করলেন(১০১)।
আর নাজিল হওয়া সেই আয়াতটি হচ্ছে,
হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য আহার্য রন্ধনের অপেক্ষা না করে নবীর গৃহে প্রবেশ করো না। তবে তোমরা আহুত হলে প্রবেশ করো, তবে অতঃপর খাওয়া শেষে আপনা আপনি চলে যেয়ো, কথাবার্তায় মশগুল হয়ে যেয়ো না। নিশ্চয় এটা নবীর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কাছে সংকোচ বোধ করেন; কিন্তু আল্লাহ সত্যকথা বলতে সংকোচ করেন না। তোমরা তাঁর পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্যে এবং তাঁদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ। আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর পত্নীগণকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ (১০২)।
এদিকে জয়নবের সাথে বিয়ে হওয়ার পরে জায়েদের সাথে আর পিতাপুত্রের সম্পর্ক রইলো না। কিন্তু জায়েদ নবী মুহাম্মদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন এবং গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। ৬২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আল্লাহর নবী জায়েদকে সেনাপতি করে একটি অসম যুদ্ধে প্রেরণ করেন। মাত্র ৩০০০ সৈন্য নিয়ে বাইজেন্টাইন শহর বসরা দখল করতে পাঠান। প্রায় দুই লক্ষ সৈন্যের বাইজেন্টাইন যৌথ বাহিনী মুতাহ নামক গ্রামে এই মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে জায়েদ মৃত্যুবরণ করেন (১০৩)।
জায়েদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে নবী মুহাম্মদ জায়েদের বাড়িতে যান। জায়েদের মেয়ে নবীকে দেখে কাঁদতে শুরু করেন। নবীও কাঁদতে থাকেন যে পর্যন্ত না জায়েদের মেয়ে শান্ত হন (১০৪)।
জয়নবকে নিয়ে একটি ঘটনা জানা প্রয়োজন। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেগানা নারী-পুরুষের মেলামেশা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। তারপরের মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে, তাঁদের মাঝে লালসা জাগ্রত হয়। প্রাসংগিকভাবেই নিম্নোক্ত হাদীসের মাধ্যমে চমৎকার একটি সমাধান পাওয়া যায়,
“জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলাকে দেখলেন। তখন তিনি তাঁর স্ত্রী যায়নাব –এর নিকট আসলেন। তিনি তখন তার একটি চামড়া পাকা করায় ব্যস্ত ছিলেন এবং রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের প্রয়োজন পূরণ করলেন। অতঃপর বের হয়ে সাহাবীগণের নিকট এসে তিনি বললেনঃ স্ত্রীলোক সামনে আসে শায়ত্বানের বেশে এবং ফিরে যায় শায়ত্বানের বেশে। অতএব তোমাদের কেউ কোন স্ত্রীলোক দেখতে পেলে সে যেন তার স্ত্রীর নিকট আসে। কারণ তা তার মনের ভেতর যা রয়েছে তা দূর করে দেয়(১০৫)।“
জয়নব ছিলেন বেশ সুশ্রী ও আকর্ষণীয়া। এই কারণে বিয়ের পর নবী মুহাম্মদ জয়নবের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। যার ইংগিত আমরা পেয়েছি হাফসার পর্বে মধুর ঘটনায়। সূরা নিসার চার নম্বর আয়াত অনুসারে একজন মুমিন বান্দার উচিত সকল স্ত্রীকে একই সময় দেয়া। শুরুর দিকে মুহাম্মদ করতেনও ঠিক তাই। পর্যায়ক্রমে একেক স্ত্রীর সাথে একেক রাত কাটাতেন। যদিও সাওদার পর্বে আমরা জেনেছি, সাওদা তাঁর ভাগের রাত আয়িশাকে দান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি কারও কারও প্রতি বিশেষ মনযোগ দিতে লাগলেন। এই বিষয়ে স্ত্রীদের মাঝে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। জয়নবের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আয়িশা ভালোভাবে নিতে পারেননি। এজন্য তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেন। ঠিক তখনই সূরা আহজাবের ৫১ নাম্বার আয়াত নাজিল হয় (১০৬),
“(হে রাসূল!) আপনি আপনার স্ত্রীদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা দূরে রাখতে পারেন এবং যাকে ইচ্ছা কাছে রাখতে পারেন। আপনি যাকে দূরে রেখেছেন, তাকে (আবার) কামনা করলে তাতে আপনার কোন ভয় নেই। এতে অধিক সম্ভাবনা আছে যে, তাদের চক্ষু শীতল থাকবে; তারা দুঃখ পাবে না এবং আপনি যা দেন, তাতে তারা সকলেই সন্তুষ্ট থাকবে। তোমাদের অন্তরে যা আছে, আল্লাহ জানেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল (১০৭)।”
এ আয়াত নাজিল হওয়ার পরপর তিনি আয়িশাকে শোনান। আয়িশা তখন বলেন, “আমি তো দেখছি আপনার রব আপনার কোন মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে দেরী করেন না (১০৮) ।“
আয়িশা-জয়নব দুজনের প্রতিই নবী মুহাম্মদের বিশেষ দুর্বলতা থাকায় দুজনের মধ্যেই বেশ স্নায়ুযুদ্ধ চলতো। নবী মুহাম্মদের স্ত্রীরা দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা আগের পর্বে জেনেছি। জয়নব-সালামার প্রতিপক্ষ দলে ছিলেন আয়িশা, হাফসা, সাওদা ও সাফিয়া। এই রেষারেষির সুত্র ধরেই জয়নব সাফিয়াকে তাঁর অতিরিক্ত উট ধার দেননি। এতে নবী মুহাম্মদ এতোই রেগে যান যে যে জয়নবের সাথে প্রায় দুইমাসের বেশি সময় কথা বলা বন্ধ রাখেন(১০৯)। জয়নব প্রায়ই গর্ব করে বলতেন, “তোমাদের বিয়ে দিয়েছে তোমাদের পরিবার পরিজন, আমার বিয়ে দিয়েছেন সপ্ত আসমানের উপর থেকে স্বয়ং আল্লাহ (১১০)।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আয়িশার বিরুদ্ধে অপবাদের ঘটনায় এই জয়নবই আয়িশার পাশে দাঁড়ান। যখন মুহাম্মদ আয়িশার চরিত্র সম্পর্কে জয়নবকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি উত্তর দেন, তিনি আয়িশার সম্পর্কে ভালো ব্যতীত কিছুই জানেন না (১১১) ।
পরবর্তীতে জয়নব সম্পর্কে আয়েশা বলেন, “আমি জয়নবের চেয়ে সত্যবাদী, খোদাভীরু, ধার্মিক, দয়ালু, নিঃস্বার্থ ও দানশীল নারী দেখিনি (১১২) ।
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর জয়নব আর মদিনা ত্যাগ করেননি। তিনি সূচীকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি লাভের বেশিরভাগ অংশই দান করে দিতেন। এমনকি উম্মুল মুমেনীন হিসেবে দ্বিতীয় খলিফা উমরের কাছ থেকে যে ভাতা পেয়েছিলেন তাঁর পুরোটাই তিনি দান করে দিয়েছেন। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর ৯ বছর পর ৬৩৯ খ্রীস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয় (৮৮)।
জয়নব পর্যন্ত কোন অমুসলিম নারী নবী মুহাম্মদের ঘরে আসেন নি। প্রথম অমুসলিম নারী আসবেন আগামী পর্বে!
তথ্যসুত্রঃ
(৮৮) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৭২-৮১।
(৮৯) তাবারী, ৩৯তম খন্ড(বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস ), পৃষ্ঠা ৮-৯।
(৯০) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৯৯।
(৯১) সহীহ বুখারী হাদিস নং ৩৮৩৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫৪৩ প্রথমাংশ, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৪৮ প্রথমাংশ।
(৯২) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮০।
(৯৩) তাফসীরে ইবনে কাসির, সূরা আহজাব আয়াত ৩৬।
(৯৪) সূরা আহজাব, আয়াত ৩৬।
(৯৫) তাবারী, ৮ম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম), পৃষ্ঠা ১-৪, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮১।
(৯৬) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৭২।
(৯৮) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮১-১৮২, ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৭২-৭৩।
(৯৯) সূরা আহজাব, আয়াত ৩৭।
(১০০) সূরা আহজাব, আয়াত ৪।
(১০১) সহীহ বুখারী হাদীস ৪৭৯৩। এ সম্পর্কিত আরও হাদীস ৪৭৯১, ৪৭৯২, ৪৭৯৪, ৫১৫৪, ৫১৬৩, ৫১৬৬, ৫১৬৮, ৫১৭০, ৫১৭১, ৫৪৬৬, ৬২৩৮, ৬২৩৯, ৬২৭১, ৭৪২১।
(১০২) সূরা আহজাব আয়াত ৫৩।
(১০৩) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৫৩২-৩৪।
(১০৪) ইবনে সা’দ, তৃতীয় খন্ড (দ্য কম্পানিয়ন অফ বদর), পৃষ্ঠা ৩৩।
(১০৫) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩২৭৩।
(১০৬) তাফসীরে ইবনে কাসির, সূরা আহজাব, আয়াত ৫১।
(১০৭) সূরা আহজাব, আয়াত ৫১।
(১০৮) সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৭৮৮।
(১০৯) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড(দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৯০।
(১১০) সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৪২০।
(১১১) সহীহ বুখারী ২৬৬১।
(১১২) সহীহ মুসলিম ৫৯৮৪।
রায়হানা বিনতে জায়েদ ইবনে আমরঃ
সত্যি বলতে রায়হানা সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। নবীর প্রথম উপপত্নী হওয়ায় ইসলামিক ইতিহাসবিদরা চেষ্টা করেছেন রায়হানাকে যতোভাবে পারা যায় লুকিয়ে রাখার জন্য। তবে রায়হানা বিনতে জায়েদকে জানতে হলে যে ঘটনা না জানলেই নয় সেটি হচ্ছে বনু কোরায়জার ঘটনা। ঘটনাটি অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর বিধায় যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে বলার চেষ্টা করছি।
খন্দকের যুদ্ধে একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে অভাবনীয় সাফল্য পায় মুসলিম বাহিনী। মদিনার তিনদিকে ছিলো পাহাড়-পর্বতে ঘেরা, শুধুমাত্র উত্তর দিক অরক্ষিত। সালমান ফারসি নামক পারস্যের এক ব্যক্তি উত্তর দিকে পরিখা খনন করার বুদ্ধি দেন (১১৩)। এই পরিখার কারণে কুরাইশরা আর আক্রমণ করতে পারেনি। এই কারণে খন্দক যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। মুসলমানদের মাত্র ৩ জন মারা যান, অপরপক্ষে কুরাইশদের ৬ জন। খন্দকের যুদ্ধ কিভাবে হয়েছিলো বুঝতে হলে মদিনার ভৌগলিক অবস্থান জানা জরুরী। মদিনার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছিলো বনু কোরায়জা গোত্র। আর সরাসরি দক্ষিণে ছিলো বনু নাদির গোত্র। এই গোত্রদ্বয়ের সাথে মুসলিমদের শান্তিচুক্তি ছিলো। আধুনিক মুসলিম স্কলাররা বলেন যে বনু কোরায়জা ও বনু নাদির গোত্রের অংশটা দিয়ে কুরাইশদের আক্রমণ করার সুযোগ ছিলো, এজন্য তাঁদের সাথে সন্ধি স্থাপন করা হয়েছিলো যেন কুরাইশদের না ঢুকতে দেয়া হয়। তবে দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণ করার জন্য কতটুকু উপযোগী সেটা পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে মানচিত্র সংযোজন করে দেয়া হল(১১৪)।
মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে কুরাইশ ও ঘাতাফান গোত্র একজোট হয়। অপরদিকে বনু নাদির গোত্রের প্রধান হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কোরায়জা গোত্রকে মোটিভেট করার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যদি উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ করা যায় তাহলে মুসলিম বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়বে, ও পরাজয় হয়ে যাবে সুনিশ্চিত। সরাসরি তাবারীর জবানীতেই যদি শুনি, “আল্লাহর শত্রু হুয়াই ইবনে আখতাব চুক্তি ও অংগীকারপত্র নিয়ে বনু কোরায়জা গোত্র প্রধান কাব বিন আসাদের সাথে দেখা করতে আসেন। কাব হুয়াইয়ের আসার সংবাদ পেয়ে মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দেন। হুয়াই যখন দুর্গের কপাট খুলতে অনুরোধ করেন, তখন কাব বলেন যে, হুয়াই অলুক্ষণে, তিনি দুর্ভোগ নিয়ে এসেছেন। তাছাড়া মুহাম্মদের মতো সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মানুষের সাথে তাঁর চুক্তিভংগ করার কোন ইচ্ছেই নেই। হুয়াই বার বার অনুরোধ করার পরেও যখন দরজা খুলে না, তখন হুয়াই বলেন, তোমার খাবার কম পড়বে এই ভয়ে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছো না, চিন্তা নেই, তোমাদের খাবার আমি নষ্ট করবো না। খাবারের খোটা দেয়ার পরে রেগে গিয়ে কাব দরজা খোলার আদেশ করেন। তখন হুয়াই কাব বিন আসাদকে অনুরোধ করতে থাকেন, বলেন আমি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছি, এর শেষ না দেখে ফিরবো না। উত্তরে কাব বলেন, “ধিক তোমাকে, তুমি সাথে করে নিয়ে এসেছো চিরস্থায়ী লজ্জা।“ তখন হুয়াই আল্লাহর নামে এই প্রতিজ্ঞা করে যে কুরাইশ ও ঘাতাবান গোত্রের লোকেরা যদি মুহাম্মদকে হত্যা করতে না পারে তাহলে সে কাবের সাথে একই দুর্গে অবস্থান করবে ও একই পরিণতি মাথা পেতে নিবে। একমাত্র এর পরেই কাব রাজী হন। নবী যখন খবর পেলেন তখন সাদ বিন মুয়াজ ও সাদ বিন উবাদাকে দিয়ে যাচাই করতে পাঠান। তাঁরা গেলে বনু কোরাইজার লোকেরা বলে, “কে আল্লাহর নবী? মুহাম্মদের সাথে আমাদের কোন চুক্তি ও অঙ্গীকার নেই (১১৫)।“
একথা শোনার পর মুসলিমরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। কারণ সামনে পিছনে দুদিকেই শত্রু। সেই সময় নুইয়াম বিন মাসুদ নামের ঘাতাফান গোত্রের একজন এসে বলেন, “হে নবী, আমি গোপনে মুসলমান হয়েছি, আমার গোত্রের কেউ সেটি জানে না। আমার সাথে সব গোত্রেরই সুসম্পর্ক রয়েছে, বলুন আমি কি কাজে লাগতে পারি।“ উত্তরে মুহাম্মদ বলেন, “দেখো তাঁদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করতে পারো কিনা,মনে রাখবে এটি প্রতারণা নয়, যুদ্ধের একটি কৌশল মাত্র।“ তখন সে গিয়ে বনু কুরাইজার কাছে গিয়ে বলে, “তোমরা বোকামী করছো। মুহাম্মদের বাহিনীর সাথে তোমরা পারবে না। আর যখন কুরাইশ ও ঘাতাফানরা হেরে যাবে তখন তোমাদের রেখেই পালাবে। তোমরা একটা কাজ করো। তাঁদের কিছু লোককে তোমাদের সাথে থাকতে বলো, যেন তোমাদেরকে সাহায্য করার জন্য তাঁদের পিছুটান থাকে।“
অপরদিকে নুইয়াম কুরাইশ ও ঘাতাফানদেরকে গিয়ে বলেন যে বনু কোরাইজা আসলে মুসলমানদের পক্ষে। তোমাদের কোন লোক পাঠাতে বললে সেখানে পাঠাবে না। কারণ তাঁরা তাঁদেরকে বন্দি করে মুসলমানদের কাছে দিয়ে দিবে।
এরপর কুরাইশদের নেতা আবু সুফিয়ান কোরাইজার কাছে যুদ্ধে যোগদানের জন্য আহবান জানিয়ে দুত পাঠান। তখন বনু কোরাইজা কিছু লোককে তাঁদের সংগে রাখতে বলে। দুত যখন কুরাইশ ও ঘাতাফানদের এই খবর দেয় তখন তাঁরা ভাবে নুয়াইম আসলেই সত্যি বলেছিলো । তাঁরা খবর পাঠায় আমরা একজন লোকও দিবো না, তোমরা যদি যুদ্ধ করতে চাও এমনিতেই এসে যুদ্ধ করো। কথিত আছে সেদিন নবী বদদোয়া করেন যে আল্লাহ তাঁদের উপর আজাব দিয়ে দেন। সত্যি সত্যি সে রাতে প্রচন্ড ঝড় হয়, ঝড়ে তাবু, আগুন , রান্নার তৈজসপত্র সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। অনেক ঘোড়া ও উট মারা যায়। কুরাইশ ও ঘাতাফানরা ফিরে যায়। মুসলিমরাও মদীনায় ফিরে আসেন। (১১৬)। একটি হাদীসে আমরা এর উল্লেখ পাই,
*আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ*
*নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত যে, তিনি খন্দকের যুদ্ধের দিন বদদু’আ করে বলছিলেন, আল্লাহ তাদের ঘরবাড়ি ও কবর আগুন দ্বারা ভরে দিন। কারণ তারা আমাদেরকে মধ্যবর্তী সলাতের সময় ব্যস্ত করে রেখেছে, এমনকি সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে (১১৭)।*
পরদিন যখন মুসলিমরা যুদ্ধবিরতিতে ছিলো এমন সময় জিব্রাইল এসে খবর দিলেন যে বনু কোরাইজারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তখন নবী সবাইকে নির্দেশ দিলেন বনু কোরাইজা পর্যন্ত পৌঁছার আগ পর্যন্ত কেউ যেন আছর না পরে। সরাসরি বুখারীর হাদীসে পাই,
*আয়েশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ*
*তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে অস্ত্র রেখে গোসল করেছেন। এমনি মুহূর্তে তাঁর কাছে জিবরীল (আঃ) এসে বললেন, আপনি অস্ত্র রেখে দিয়েছেন। আল্লাহর কসম! আমরা তা খুলিনি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে চলুন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে? তিনি বনূ কুরাইযার প্রতি ইশারা করে বললেন, ঐ দিকে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন (১১৮)।*
মুসলিমরা তখন বনু কোরায়জার দুর্গের বাইরে অবস্থান নেন। পূর্ব-প্রতিজ্ঞাবশত হুয়াই ইবনে আখতাবও বনু কোরাইজা গোত্রের সাথে দুর্গের ভিতরে অবস্থান নেন। মুসলমানরা পঁচিশ রাত পর্যন্ত দুর্গ ঘেরাও করে রাখেন। নবী মুহাম্মদ তাঁদের কাছে প্রস্তাব রাখেন তাঁরা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে তিনি তাঁদেরকে ক্ষমা করে দিবেন ও মুক্তি দিবেন। নিরুপায় হয়ে গোত্র প্রধান কাব বিন আসাদ গোত্রের লোকদেরকে তিনটি অপশন দেন।
১। এই লোককে আল্লাহর নবী হিসেবে মেনে নেবো।
উত্তরে তাঁরা বলে, আমরা তাওরাত বর্জন করবো না। কোন কিছুর বিনিময়ে পরিবর্তন করবো না।
২। তাহলে আমরা আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে মুহাম্মদের সাথে লড়াই করি। যাতে আমাদের কোন পিছুটান না থাকে।
তাঁরা আবারও উত্তর দেয়, “তাঁরা যদি মরেই যায় তবে আমাদের বেঁচে থেকেই বা কি লাভ?”
৩। আজকে সাবাহ এর রাত্রি। এদিন আমরা অতর্কিতে আক্রমণ করি। ওরা জানে যে সাবাহ এর রাত্রিতে আমরা আক্রমণ করবো না।
তাঁরা পুনরায় উত্তরে বলে, “আমাদের সাবাহর দিনটি কি অপবিত্র করা উচিত হবে যার কারণে পূর্বপুরুষ বানরে রুপান্তরিত হয়েছিলো?”
তখন অসহায় চোখে কাব আহবান করেন, “কেউ কি আছে যে এর সমাধান করতে পারে?”
সবাই শলাপরামর্শ করে নবীর কাছে খবর পাঠান,”বনি আমর বিন আউস গোত্রের আবু লুবাবাকে বিন আবদুল মুনধিরকে আমাদের কাছে পাঠান যেন আমরা তাঁর সাথে আলোচনা করতে পারি।“ মহিলা ও শিশুরা লুবাবাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। লুবাবাও তা দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা জিজ্ঞেস করে, “আবু লুবাবা তোমার কি মনে হয় আমাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত। সে উত্তর দেয় হ্যাঁ, তারপর গলার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বোঝায় এর মানে হলো নিশ্চিত হত্যা। আবু লুবাবা বলেন, আমি আল্লাহ ও রসুলের নামে তাঁদেরকে মিথ্যা বলেছি তা বুঝতে পেরে আমার পা সেখান থেকে সরছিলো না। তারপর নবীর কাছে প্রত্যাবর্তন না করে একটি মসজিদের থামের সাথে নিজেকে বেঁধে রাখেন এবং বলেন, আমার কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই স্থান থেকে কোথাও যাবো না। নবী অনেকক্ষণ আবু লুবাবার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি ঘটনা শোনার পর বলেন, সে যদি আমার কাছে এসে সব খুলে বলতো তাহলে আমি হয়তো তাঁর ক্ষমা প্রার্থনার ব্যবস্থা করতাম, কিন্তু সে এই কাজ করায় আমার কিছু করার নেই। আল্লাহ যে পর্যন্ত না তাঁকে ক্ষমা করে সে পর্যন্ত আমি তাঁকে কোথাও যেতে দিবো না (১১৯)।
ইবনে হিশামের বক্তব্য অনুসারে তখন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাজিল হয় (১২০),
**হে ঈমানদারগণ, খেয়ানত করোনা আল্লাহর সাথে ও রসূলের সাথে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে(১২১)।**
আল্লাহর নবীর কাছে আবু লুবাবার ক্ষমা করার খবরটি আসে পরদিন ভোরে যখন তিনি সালামার ঘরে ছিলেন । তখন নিম্নোক্ত দুটি আয়াত নাজিল হয়,
**১। আর কোন কোন লোক রয়েছে যারা নি জেদের পাপ স্বীকার করেছে, তারা মিশ্রিত করেছে একটি নেককাজ ও অন্য একটি বদকাজ। শীঘ্রই আল্লাহ হয়ত তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। নিঃঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।**
**২। তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুতঃ আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন(১২২)।**
পঁচিশ দিন অব্রুদ্ধ থাকার পর বনু কোরায়জার লোকেরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেন। তখন তাঁদের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে মুসলমানদের মিত্র আউস গোত্রের লোকেরা দৌড়ে নবীর কাছে এসে অনুনয় করে বলে, “এদের ক্ষমা করে দিন, এদের প্রাণভিক্ষা দিন, এরা আমাদের মিত্র ছিলো।“ উত্তরে নবী বলেন, “তোমাদের গোত্রের কেউ যদি রায় দেয় তাহলে কি তোমরা মানবে?” তখন তাঁরা রাজি হয়। তখন তাঁরা উৎফুল্ল হয় এই ভেবে যে নিশ্চয়ই তাঁরা প্রাণে রক্ষা পাবে। তখন নবী ঘোষণা দেন সাদ বিন মুয়াজ হবেন সেই বিচারক।
ঘোষণা শুনে আউস গোত্রের লোকেরা ভীষণ ভয় পায়, কেননা সাদ বিন মুয়াজ ছিলেন খন্দকের যুদ্ধে আহত এবং বনু কোরায়জার প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন। তখন তাঁর গোত্রের লোকেরা বারবার অনুনয় করে যে, তুমি তাঁদের প্রতি একটু সদয় হও,সেই কারণেই আল্লাহর নবী তোমাকে বিচারক নিযুক্ত করেছেন। উত্তরে সাদ বলেন,
“এখন তাঁর সময় এসেছে আল্লাহর নিমিত্তে কিছু করার, কারো অনুরোধে কিছু করার নয়। “
সাদ তখন বলেন, “তোমরা কি আল্লাহর নামে অঙ্গীকারবদ্ধ যে আমি যে রায় দিবো তোমরা সেটা মেনে নেবে? সবাই তখন বলে, হ্যাঁ ।“
সাদ তখন রায় দেন, “পবিত্র গ্রন্থ তাওরাত অনুসারে আমি এই রায় দিলাম, গুপ্তকেশ পরীক্ষা করে সকল সাবালক পুরুষকে হত্যা, নারী, শিশু ও সকল সম্পদ বন্টন।
দেখি পবিত্র গ্রন্থ তাওরাতে বুক অফ ডিউটেরোনমিতে কি লেখা আছে,
***“তোমরা যখন একটি শহর আক্রমণ করো, প্রথমে তাঁদেরকে শান্তি প্রস্তাব দাও। তাঁরা যদি রাজি হয় এবং দরজা খুলে দেয় তাঁরা তোমাদের দাসে রুপান্তরিত হবে এবং তোমাদের সেবা করবে। তাঁরা যদি রাজি না হয়, তাহলে আক্রমণ করো এবং সকল সাবালক পুরুষকে হত্যা করো, কিন্তু সকল নারী, শিশু, পশু ও সম্পদ তোমরা ভাগাভাগি করে নাও। তোমরা তা উপভোগ করো তোমাদের রব যা তোমাদের দিয়েছেন। তোমরা প্রত্যেক শহরেই একই পন্থা অবলম্বন করবে (১২৩)।“***
নবী তখন বলেন, “তুমি যে রায়টি দিয়েছো সেটি হচ্ছে সাত আসমানের উপর অধিষ্ঠিত আল্লাহর রায়। “
এরপর শুরু হয় সেই মহা হত্যাযজ্ঞ। মদিনার বাজারের মাঝখানে বিশাল একটি গর্ত খনন করা হয়। একে একে প্রায় ৬০০ থেকে ৯০০ লোককে হত্যা সেদিন গলা কেটে হত্যা করা হয়। তখন হিটলারের গ্যাস চেম্বারের মতো একসাথে অনেক লোককে মারার ব্যবস্থা ছিলো না। তাই সেদিন এই গণমৃত্যুদন্ড খুব ভোর থেকে শুরু হলেও শেষ হতে হতে মধ্যরাত পর্যন্ত লেগে যায় । কাব বিন আসাদ ও হুয়াই ইবনে আখতাব দুইজনকেই সেদিন হত্যা করা হয়। হুয়াই তাঁর জামাকাপড়ে ছিদ্র করে রেখেছিলেন যেন লুটের মাল হিসেবে ব্যবহার করা না যায়। এই হুয়াই ইবনে আখতাবের মেয়ে সাফিয়াও পরবর্তীতে নবীর স্ত্রী হন।
আয়িশাও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো মোটে তের কি চৌদ্দ । তিনি ছিলেন সেই ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আমরা আয়িশার জবানীতেই সেদিনের একটি ঘটনা শুনি।
*“আয়ীশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ*
*তিনি বলেন, বনী কুরাইযার কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। তবে এক মহিলাকে হত্যা করা হয়। সে আমার পাশে বসে কথা বলছিল এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাজারে তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তার নাম ধরে ডেকে বললো, অমুক মহিলাটি কোথায়? সে বললো, আমি। আমি (‘আয়ীশাহ) বললাম, তোমার কি হলো? (ডাকছো কেন?) সে বললো, আমি যা ঘটিয়েছি সেজন্য (সে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়েছিলো)। ‘আয়ীশাহ (রাঃ) বলেন, তাকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হলো। আমি ঘটনাটি আজও ভুলতে পারিনি। আমি তার এ আচরণে অবাক হয়েছিলাম যে, তাকে হত্যা করা হবে একথা জেনেও সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো (১২৪)।“*
সেদিনের সেই মহিলাটির নাম ছিলো বুনানা, তিনি ছিলেন বনু কোরায়জা গোত্রের আল-হাকাম আল কুরাজির স্ত্রী। মহিলাটিকে হত্যা করেছিলেন নবী মুহাম্মদ নিজে(১২৫)।
সেদিনের সেই ঘটনার চমৎকার বিবরণ আছে সূরা আহজাবে,
১। **আর কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ হতে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন; তোমরা তাদের কিছু সংখ্যককে হত্যা করছি এবং কিছু সংখ্যককে করছ বন্দী।**
**২। আর তিনি তোমাদেরকে অধিকারী করলেন তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী ও ধন-সম্পদের এবং এমন ভূমির যাতে তোমরা এখনো পদার্পন করনি। আর আল্লাহ্‌ সবকিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান (১২৬) ।**
এরপর সবকিছু ভাগাভাগি হয় সূরা আনফালে বর্ণিত গনিমতের সম্পদ ভাগাভাগির নিয়মে। চলুন দেখে নিই নিয়মটি,
**আর এ কথাও জেনে রাখ যে, কোন বস্তু-সামগ্ রীর মধ্য থেকে যা কিছু তোমরা গনীমত হিসাবে পাবে, তার এক পঞ্চমাংশ হল আল্লাহর জন্য, রসূলের জন্য, তাঁর নিকটাত্নীয়-স্বজনের জন্য এবং এতীম-অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য; যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর উপর এবং সে বিষয়ের উপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি ফয়সালার দিনে, যেদিন সম্মুখীন হয়ে যায় উভয় সেনাদল। আর আল্লাহ সব কিছুর উপরই ক্ষমতাশীল (১২৭)।**
ভাগাভাগি শেষ হলে নবী মুহাম্মদ সাদ বিন জায়েদ আনসারিকে কিছু বন্দী নারীকে নাজাদ অঞ্চলে পাঠান তাঁদেরকে বিক্রি করে ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্র বিনিময়ে কেনার জন্য।
এরপর বন্দী নারীদের ভেতর থেকে সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে তিনি নিজের জন্য বাছাই করেন। সেই নারীটির নাম হচ্ছে রায়হানা বিনতে জায়েদ ইবনে আমর।
রায়হানা ছিলেন বনু নাদির গোত্রের একজন প্রভাবশালী নেতার মেয়ে এবং তাঁর স্বামীর নাম ছিলো আল-হাকাম। আল হাকামের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর নবী রায়হানাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন ও বিয়ের প্রস্তাব দেন। সেই সাথে তাঁকে পর্দা করারও নির্দেশ দেন। তিনি উত্তরে বলেন, “আপনি আমাকে দাসী হিসেবেই রাখেন। সেটি আমার ও আপনার দুজনের জন্যই সহজ হবে।“ এখানে উল্লেখ্য, সেই সময় ইসলামে নারীদের জন্য পর্দা বাধ্যতামূলক ছিলো, কিন্তু দাসীদের জন্য নয়। রায়হানা নবীর সামনেই ইসলামের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন। যুদ্ধবন্দী নারী হয়ে এতোবড় স্পর্ধা দেখানোর পরও নবী তাঁকে কোন শাস্তি দেননি। এ ঘটনায় নবী কিঞ্চিৎ বিরক্ত হন এবং তাঁকে দাসী হিসেবেই রাখেন (১২৮)।
অনেক আধুনিক ইসলামিক স্কলারের মত অনুসারে রায়হানা এবং মারিয়া কিবতিয়া দাসী ছিলেন না। অনেকেই বলেন শুরুর দিকে রায়হানা অস্বীকৃতি জানালেও পরবর্তীতে আল্লাহর নবী রায়হানাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন এবং ইসলাম ধর্মে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলামিক স্কলারদের মতে, আরো বড় যুদ্ধ এড়ানোর জন্য এই কঠোর শাস্তি দরকার ছিলো। এ রায়ের ফলে আরবের বাকি সব গোত্র মুসলমানদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা পায় ও শত্রুতা এড়ানোর চেষ্টা করে। তাঁরা আরো বলেন, বনু কোরায়জার চুক্তিভংগ মুসলমানদের বিপদের কারণ হতে পারতো এবং তাঁদের শাস্তি হয়েছে তাদেরই ধর্মগ্রন্থ তাওরাত অনুসারে। তাছাড়া তাদেরকে আহবান জানানো হয়েছিলো ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু তাঁরা জেনেশুনে প্রত্যাখ্যান করে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। অনেক স্কলারই অবশ্য দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ধর্মবিশ্বাসের জন্য তাঁদেরকে হত্যা করা হয়নি, হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। আর ইহুদীরা যদি সুযোগ পেতো তাহলে মুসলিমদের পরিণতিও ঠিক একই হতো।
সে যাইহোক প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঠিক কি হয়েছিলো এ সত্য জানা আমাদের পক্ষে কঠিন। তবে রায়হানা কি সত্যিই মুসলিম হয়েছিলো কিনা, এবং তেরো চৌদ্দ বছর বয়সী আয়িশার মনের উপর এই ঘটনার কিরকম প্রভাব পড়েছিলো এটি বিচার বিশ্লেষণের দায়িত্ব একান্তই পাঠকের। আর সেই সাথে প্রস্তুতি নিন পরবর্তী পর্বের, যে পর্বে মুহাম্মদ আক্রমণ করবেন বনু আল মুসতালিক নামের আরেকটি গোত্রকে এবং বন্দী করবেন আরেকজন সুন্দরী রাজকন্যা প্রিন্সেস জুওয়াইরিয়াকে!
তথ্যসূত্রঃ
(১১৩) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৫১-৫২।
(১১৫) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ১৪- ১৫, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৫৩।
(১১৬) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ২৩- ২৪, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৫৮-৪৬০।
(১১৭) বুখারী, ৪১১১ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৮০৮)।
(১১৮) বুখারী ৪১১৭, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৮১৪ )।
(১১৯) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ২৬- ৩১, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৬১-৬৩।
(১২০) ইবনে হিশাম নোটস ৭০৭, পৃষ্ঠা ৭৬৪।
(১২১) সূরা আনফাল, আয়াত ২৭।
(১২২) সূরা তাওবা, আয়াত ১০২-০৩।
(১২৩) ওল্ড টেস্টামেন্ট, বুক অফ ডিউটেরানমি, ২০ঃ১০-১৬।
(১২৪) সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৬৭১।
(১২৫) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম), পৃষ্ঠা ৩২- ৩৪, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৬৩-৬৪।
(১২৬) সূরা আহজাব, আয়াত ২৬-২৭।
(১২৭) সূরা আনফাল, আয়াত ৪১।
(১২৮) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম), পৃষ্ঠা ৩৮- ৩৯, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৬৬।

প্রিন্সেস_জুয়াইরিয়া, জুয়াইরিয়া বিনতে আল হারিসঃ

প্রিন্সেস জুয়াইরিয়া, বনু আল-মুসতালিক গোত্রের নেতা আল হারিস বিন আবু দিরারের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা। অত্যন্ত ধনী পরিবারের নারী ছিলেন তিনি এবং ছিলেন বাবার খুব আদরের মেয়ে। যারা তাঁকে দেখতেন তাঁরাই তাঁর সৌন্দর্য ও বাগ্মীতায় মুগ্ধ হয়ে যেতেন। রুপকথার সেই রাজকন্যার মতো সুন্দরী নারী জুয়াইরিয়া কিভাবে তাঁর প্রথম স্বামীকে হারালেন এবং উম্মুল মুমিনীনদের অন্তর্ভুক্ত হলেন তাই থাকছে আজকের পর্বে।
সময়টি বনু কোরায়জা আক্রমণের প্রায় সাড়ে সাত মাস পরের ঘটনা। এই বনু মুসতালিক অভিযান থেকে ফেরার পথেই আয়িশার নামে ব্যভিচারের গুজব ছড়িয়েছিলো যা আমরা তৃতীয় পর্বে জেনেছি।
ইবনে ইশাকের বর্ণনায়, বনু লিহায়েন অভিযানের পরপরই আল্লাহর নবী খবর পান যে বনু আল-মুসতালিক গোত্রের লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে একত্রিত হচ্ছে। তখন তিনি পরিকল্পনা করেন এবং অকস্মাৎ আক্রমণ করে শত্রুপক্ষকে চমকে দিতে চান (১২৯) । মুসলিম শরীফের হাদীসে এর একটি বর্ণনা এসেছে,
ইবনে ‘আওন (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি নাফি’ (রহঃ) -কে এ কথা জানতে চেয়ে পত্র লিখলাম যে, যুদ্ধের পূর্বে বিধর্মীদের প্রতি দ্বীনের দা‘ওয়াত দেয়া প্রয়োজন কি-না? ইবনু ‘আওন বলেন, তখন তিনি আমাকে লিখলেন যে, এ (প্রথা) ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে ছিল। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বানূ মুসতালিকের উপর অতর্কিত আক্রমণ করলেন এমন অবস্থায় যে, তাদের পশুদের পানি পান করানো হচ্ছিল। তিনি তাদের যোদ্ধাদের হত্যা করলেন এবং বাকীদের বন্দী করলেন। আর সেদিনেই তাঁর হস্তগত হয়েছিল- ইয়াহইয়া বলেন যে, আমার মনে হয় তিনি বলেছেন – ‘জুওয়াইরিয়াহ্’ কিংবা নিশ্চিতরূপে বলেছেন ‘হারিসের কন্যা’। বর্ণনাকারী বলেন, এ হাদীস আমাকে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি তখন সে সেনাদলের মধ্যে ছিলেন (১৩০)।
এই আক্রমণে প্রায় বিনা বাধায় মুসলিমরা বিজয়ী হয়। বনু মুসতালিক গোত্রের প্রায় দশজন লোক নিহত হয়। জুয়াইরিয়ার স্বামী মুস্তফা বিন সাফওয়ানও মারা যান এই হামলায়(১৩১)। তাঁদের সমস্ত সম্পদ, অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়ার জিন ও নারীরা মুসলমানদের করায়ত্ত হয়। মুসলমানরা এছাড়াও প্রায় ২০০ টি উট, ৫০০০ ভেড়া ও ছাগল, এবং প্রচুর দ্রব্য সামগ্রীর অধিকার লাভ করেন। যুদ্ধবন্দী নারীদের ভাগাভাগি করে নেয়ার পরে সাহাবীরা একটি বিষয় নিয়ে দ্বিধাদন্দে ভোগা শুরু করেন, যে নারীদেরকে গর্ভবতী বানানো উচিত হবে কিনা। সহীহ বুখারীর হাদীসে পাই,
“আবূ সা’ঈদ খুদ্‌রী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বানী মুসতালিক যুদ্ধ বিষয়ে বর্ণনা করেন যে, মুসলিমগণ যুদ্ধে কতকগুলো বন্দিনী লাভ করলেন। এরপর তাঁরা এদেরকে ভোগ করতে চাইলেন। আবার তারা যেন গর্ভবতী হয়ে না পড়ে সে ইচ্ছাও তারা করছিলেন। তাই তারা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে আযল বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এতে তোমাদের কোন লাভ নেই। কারণ আল্লাহ্ কিয়ামাত পর্যন্ত যত জীবন সৃষ্টি করবেন, তা সবই লিখে রেখেছেন। মুজাহিদ (রহঃ) কাযআ (রহঃ) -এর মাধ্যমে আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যত জীবন সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা অবশ্যই তা সৃষ্টি করবেনই (১৩২)।“
যখন নবী বন্দীদের বন্টন করছিলেন তখন জুয়াইরিয়া থাবিত বিন কায়েসের দুঃসম্পর্কের এক ভাইয়ের ভাগে পড়েন। থাবিত জুয়াইরিয়াকে দেখে পাগল হয়ে যান। তিনি মদীনার খেজুরের বিনিময়ে সাথে সাথেই তাঁকে নিজের জন্য কিনে নেন (১২৯)। তাঁর সৌন্দর্যের আভাস আয়িশার বর্ণনাতেই পাওয়া যায়,
“আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, বনী মুস্তালিক যুদ্ধে ‘জুয়ায়রিয়াহ বিনতুল হারিস ইবনুল মুস্‌তালিক’ বন্দিনী হয়ে সাবিত ইবনু ক্বায়িস ইবনু শাম্মাস (রাঃ) বা তার চাচাত ভাইয়ের ভাগে পড়েন। অতঃপর তিনি নিজেকে আযাদ করার চুক্তি করেন। তিনি খুবই সুন্দরী নারী ছিলেন, নজর কাড়া রূপ ছিল তার। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, তিনি চুক্তির অর্থ চাইতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলেন। তিনি দরজায় এসে দাঁড়াতেই আমি তাকে দেখে অসন্তুষ্ট হলাম। আমি ভাবলাম, যে রূপ-লাবন্যে তাকে দেখেছি, শিঘ্রই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও তাকে এভাবে দেখবেন। অতঃপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি জুয়ায়রিয়াহ বিনতুল হারিস, আমার সামাজিক অবস্থান অবশ্যই আপনার নিকট স্পষ্ট। আমি সাবিত ইবনু ক্বায়িস ইবনু শাম্মাসের ভাগে পড়েছি। আমি মুক্ত হওয়ার চুক্তিপত্র করেছি, চুক্তির নির্ধারিত অর্থ আদায়ে সাহায্য চাইতে আপনার কাছে এসেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এর চেয়ে ভালো প্রস্তাবে তুমি রাজি আছো কি? তিনি বললেন, কী প্রস্তাব, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ আমি চুক্তির সমস্ত পাওনা শোধ করে তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তিনি বললেন, হাঁ, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি আছি। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুয়ায়রিয়াহকে বিয়ে করেছেন, একথা সবার মাঝে জানাজানি হয়ে গেলো। তারা তাদের আওতাধীন সমস্ত বন্দীকে আযাদ করে ছাড়তে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, এরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শ্বশুর বংশের লোক। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, নিজের গোত্রের কল্যাণের জন্য তার চাইতে বরকতময়ী মহিলা আমি আর কাউকে দেখিনি। শুধু তার মাধ্যমে বনী মুস্তালিকের একশো পরিবার আযাদ হয়েছে। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুসলিম শাসক সরাসরি বিয়ে করতে পারেন (১৩৩)।“
জুয়াইরিয়া সম্পর্কে আর খুব বেশি কিছু জানা যায় না। জুয়াইরিয়ার মুখ থেকে মাত্র দুটি হাদীস পাওয়া যায়। দুটি হাদীসই নীচে উল্লেখ করে দিলাম।
১। জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু’আর দিনে তাঁর নিকট প্রবেশ করেন তখন তিনি (জুয়াইরিয়া) সওম পালনরত ছিলেন। আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি গতকাল সওম পালন করেছিলে? তিনি বললেন, না। আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি আগামীকাল সওম পালনের ইচ্ছা রাখো? তিনি বললেন, না। আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাহলে সওম ভেঙ্গে ফেল। হাম্মাদ ইব্‌নুল জা’দ (রহঃ) স্বীয় সূত্রে জুয়াইরিয়া (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে আদেশ দেন এবং তিনি সওম ভঙ্গ করেন (১৩৪)।
ঠিক কি কারণে তিনি রোজা ভাংগার নির্দেশ দিয়েছেন এর ব্যাখ্যা কোন নির্ভরযোগ্য কোন ইসলামিক উৎসে পাওয়া যায় না, অন্তত আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাইনি। সুতরাং রোজা ভাংগানোর কারণ বিচার বিশ্লেষণের দায়িত্ব নিতেও আমি ইচ্ছুক নই। আধুনিক ইসলামিক স্কলাররা বলে থাকেন ইসলাম গ্রহণের পর জুয়াইরিয়া খুবই ধার্মিক জীবন-যাপন করতেন এবং দিনের বেশিরভাগ সময় ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকতেন,তাঁরা নিম্নোক্ত হাদীসের রেফারেন্স দেন।
জুয়াইরিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা সকালের নামায পড়ে তাঁর কাছ থেকে উঠে বাইরে গেলেন। তিনি তখন তাঁর মসজিদ (নামাযের স্থানে) বসে ছিলেন। তারপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাশ্‌তের সময় ফিরে এলেন । তখনও তিনি (জুয়াইরিয়া) বসে ছিলেন। তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, “আমি তোমাকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম সেই অবস্থাতেই তুমি তখন থেকে বসে রয়েছ? তিনি জবাবে বললেন, হ্যাঁ। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আমি তোমার নিকট থেকে যাওয়ার পর চারটি কালেমা তিনবার পাঠ করেছি। আজ এ পর্যন্ত যা তুমি পাঠ করেছো তার সাথে ওজন করলে এই কালেমা চারটির ওজনই বেশী। কালেমা গুলো হলো, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, আদাদা খালক্বিহি, ওয়া রিযা নাফসিহি, ওয়া যিনাতা আরশিহি, ওয়া মিদাদা কালিমাতিহি।’
অর্থাৎ, আমি আল্লাহ্‌র প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা করছি তাঁর অগণিত সৃষ্টির সমান, তাঁর সন্তুষ্টি সমান, তাঁর আরশের ওজনের পরিমাণ ও তাঁর কালেমা লিখতে যত কালির প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ (১৩৫)।
নবীর মৃত্যুপরবর্তী জুয়াইরিয়ার জীবন কেমন ছিলো সেটি জানা যায় না। খলিফা উমরের শাসনের সময় উমর উম্মুল মুমেনীনদের প্রত্যেকের জন্য ১২০০০ দিরহাম ভাতার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু জুয়াইরিয়া ও সাফিয়াকে ৬০০০ দিরহাম অফার করেন। দুজনেই তা নিতে অস্বীকার করলে শেষ পর্যন্ত দুইজনকেই ১২০০০ দিরহাম করে দিতে রাজী হন খলিফা উমর। ৬৭৩ খ্রীস্টাব্দে প্রায় ৬৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অন্যান্য উম্মুল মুমেনীনদের মতো তাঁকেও জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়।
পরবর্তী পর্ব এমন এক নারীর, যিনি শত্রুপক্ষের নেতার কন্যা হয়েও নবী মুহাম্মদের প্রতি চরম অনুরক্ত ছিলেন। নবীর বিপক্ষে কথা বলার জন্য জন্মদাতা পিতাকেও তিনি তীব্র তিরস্কার করেন। সুতরাং, তাঁর অপেক্ষায় থাকুন!
তথ্যসুত্রঃ
(১২৯) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৪৯৩।
(১৩০) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৪১১, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৩৭০)।
(১৩১) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৮৩।
(১৩২) সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৪০৯, (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৯৯৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৯০৫) ।
(১৩৩) আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৯৩১।
(১৩৪) সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৮৬।
(১৩৫) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭২৬।

রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান (উম্মে হাবিবা)ঃ


মেহেরজান সিনেমাটির কথা মনে আছে কারো? যুদ্ধ ও ভালোবাসার গল্প? পাকিস্তানী সৈন্যের সাথে বাংলাদেশী নারীর প্রেম নিয়ে সেই যে বিতর্কিত ও নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমাটি? যদিও সিনেমাটি আমি দেখিনি, তবে আজকের পর্বটা অনেকটা সেরকমই। আগের দুটি যুদ্ধের পর, আজকে শুধুই প্রেমের গল্প।
রামালাহ ছিলেন কুরাইশ নেতা আবু-সুফিয়ানের কন্যা। রামালাহ এবং তাঁর স্বামী উবায়দুল্লাহ বিন জাহশ প্রথম ইসলাম গ্রহনকারীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা দুইজনেই ৬১৫ সালে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রামালাহর আরেক নাম উম্মে হাবীবা (হাবীবার মাতা) হওয়ার কারণ হচ্ছে তাঁর মেয়ের নাম হাবীবা। হিজরতের কিছুদিন পরের উবায়দুল্লাহর ভিমরতি হয়। তিনি ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীস্টান হয়ে যান। এই প্রসঙ্গে উম্মে হাবীবা বর্ণনা করেন,
“আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ আর তিনি গোমরাহ হয়ে গেছেন এবং চেহারা, আকার-আকৃতি কদর্য হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সকালে উঠে সত্যি সত্যি তিনি বলেন যে তিনি চিন্তা করে দেখেছেন যে খ্রীস্টান ধর্মের চেয়ে ভালো কোন ধর্ম নেই, সুতরাং তিনি ধর্ম পরিবর্তন করবেন। তখন আমি আমার স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে তাঁকে সুপথে ফেরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে আমার কথা পাত্তা দেয় না, মদ্যপান করতে থাকে এবং একদিন অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই তিনি মারা যান।“
আবিসিনিয়ার তৎকালীন রাজা ছিলেন নিগাস। তিনি মুহাম্মদকে চরম ভক্তি করতেন, সেই সাথে মুসলিমদেরকেও অতি যত্নের সাথে দেখভাল করতেন। সেকারণে স্বামী মারা যাওয়ার পরেও উম্মে হাবীবা বেশ ভালো অবস্থায় ছিলেন।
একদিন উম্মে হাবীবা আরেকটি স্বপ্ন দেখেন যে অপরিচিত কেউ তাঁকে উম্মুল মুমেনীন বলে সম্বোধন করছে। তিনি এই স্বপ্ন দেখে ভীষণ শিহরিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে তাঁর সাথে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের বিয়ে হতে পারে। সত্যি সত্যিই আবরাহা নামক এক দাসীর মাধ্যমে আল্লাহর নবী বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তখন আবেগাপ্লুত হয়ে উম্মে হাবীবা বলেন, "আল্লাহ যেন তোমাকেও কোন সু-সংবাদ প্রেরণ করেন।" তখন আবরাহা বলে, রসুল আপনাকে একজন অভিভাবক নিযুক্ত করতে বলেছেন ( ১৩৬ )।
উম্মে হাবিবা খালিদ বিন সাইদ কে ডেকে পাঠান ও তাকে এই দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। তার কাছে মেয়েটির আনা এই সংবাদে তিনি এতই খুশি হোন যে তিনি আবরাহা-কে সাথে সাথেই দু'টি রূপার ব্রেসলেট, দুটি নূপুর ও কিছু আংটি প্রদান করেন, যা তিনি তার পায়ে ও পায়ের আঙ্গুল গুলোতে পরিধান করতেন। (১৩৭)
এরপর খালিদ বিন সাইদ আর রাজা নিগাস বেশ ঘটা করে বিয়ের আয়োজন করেন। রাজা নিগাস খুশি হয়ে জন্য উম্মে হাবীবাকে চারশো দিনার উপহার পাঠান। উম্মে হাবীবা খুশি হয়ে আবার আবরাহাকে ডেকে পাঠান আর বলেন, “ওইদিন তোমাকে খুব বেশি কিছু দিতে পারিনি, আমার কাছে খুব বেশি অর্থকড়ি ছিলো না তাই, এই নাও পঞ্চাশটি স্বর্ণ-মুদ্রা, তোমার ইচ্ছামতো যা খুশি খরচ করো।“ পরে আবরাহা একটি বাক্সে সবকিছু নিয়ে এসে বলে, “রাজামশাই আপনার কাছ থেকে কিছু নিতে মানা করেছেন।“ পরদিন রাজা নিগাস তাঁর স্ত্রীদের নির্দেশ দেন তাঁদের সমস্ত সুগন্ধী যেন উম্মে হাবীবাকে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন আবরাহা ঘৃতকুমারী, জাফরান, অম্বর ও গন্ধগোকুল নানাকিছুর সুগন্ধী নিয়ে আসে। বলা বাহুল্য বিয়ের পরে সেগুলো ব্যবহার করতে নিষেধ করেননি।
পরবর্তীতে আবরাহা অনুরোধ করে তিনি যেন নবীর কাছে আবরাহার জন্য সুপারিশ করেন। আবরাহার যত্ন আত্তি ও ব্যবহারের কথা নবীর কাছে বলার পর নবী মৃদু হাসেন ও আল্লাহর কাছে আবরাহার মংগল কামনা করে দোয়া করেন (১৩৬)।
আবু-সুফিয়ান খবর পান নবী আবারও বিয়ে করেছেন, এবং পাত্রী আর কেউ নন, তাঁর নিজেরই কন্যা। তখন তিনি নবীকে উদ্দেশ্য করে ক্ষোভে বলে উঠেন,
“ঐ ঘোড়াটির তো দেখছি নাক সংযত হবার নয় (That stallion' s nose is not to be restrained)(১৩৮)!”
মক্কা বিজয়ের অল্প কিছুদিন পূর্বে নবী মুহাম্মদের সাথে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান মদিনা গমন করেন। তিনি প্রথমে তার কন্যা উম্মে হাবিবার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি যখন বিছানায় বসতে উদ্দত হন তখন উম্মে হাবিবা সাথে সাথে তাঁকে থামিয়ে বিছানা গুটিয়ে ফেলেন। তিনি ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস তিনি বলেন, "হে আমার কন্যা, আল্লাহর কসম, আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি মনে করছো বিছানাটি আমার বসার উপযুক্ত না, নাকি আমি এই বিছানায় বসার যোগ্য না?" উত্তরে উম্মে হাবীবা বলেন, "এই বিছানাটি আল্লাহর নবীর, আর তুমি হলে এক অপবিত্র মুশরিক। আমি চাই নাই যে তুমি আল্লাহর নবীর বিছানায় বসো।" উত্তরে আবু সুফিয়ান বললেন, "হে আমার কন্যা, আল্লাহর শপথ, আমাকে ছেড়ে আসার পর তোমার উপরে শয়তান ভর করেছে (১৩৯)।“
উম্মে হাবীবা আল্লাহর রাসুলের কতটুকু গুনমুগ্ধ ছিলেন সেটি নীচের হাদীসে বোঝা যায়। তিনি নিজের আপন বোনকে পর্যন্ত তাঁর কাছে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন!
উম্মু হাবীবা বিনতে আবূ সুফ্‌ইয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - কে বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি আমার বোন আবূ সুফিয়ানের কন্যাকে বিয়ে করুন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি কি এটা পছন্দ কর? তিনি উত্তর করলেন, হাঁ। এখন তো আমি আপনার একক স্ত্রী নই এবং আমি চাই যে, আমার বোনও আমার সাথে উত্তম কাজে অংশীদার হোক। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তর দিলেন, এটা আমার জন্য হালাল নয়। আমি বললাম, আমরা শুনতে পেলাম, আপনি নাকি আবূ সালামার মেয়েকে বিয়ে করতে চান। তিনি বললেন, তুমি বলতে চাচ্ছ যে, আমি উম্মু সালামার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, যদি সে আমার প্রতিপালিতা কন্যা না হত, তাহলেও তাকে বিয়ে করা হালাল হত না। কেননা, সে দুধ সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার ভাতিজী। কেননা, আমাকে এবং আবূ সালামাকে সুওয়াইবা দুধ পান করিয়েছে। সুতরাং, তোমরা তোমাদের কন্যা ও বোনদেরকে বিয়ের জন্য পেশ করো না। ‘উরওয়া (রাঃ) বর্ণনা করেন, সুওয়াইবা ছিল আবূ লাহাবের দাসী এবং সে তাকে আযাদ করে দিয়েছিল। এরপর রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - কে দুধ পান করায়। আবূ লাহাব যখন মারা গেল, তার একজন আত্মীয় তাকে স্বপ্নে দেখল যে, সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে নিপতিত আছে। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে। আবূ লাহাব বলল, যখন থেকে তোমাদের হতে দূরে আছি, তখন থেকেই ভীষণ কষ্টে আছি। কিন্তু সুওয়াইবাকে আযাদ করার কারণে কিছু পানি পান করতে পারছি (১৪০)।
রামালাহর সাথে বিয়েটার রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। প্রতিপক্ষ নেতার জন্য নিজের মেয়ের পাগল হয়ে যাওয়াটা নেতা হিসেবে আবু সুফিয়ান ও পুরো কুরাইশ গোত্রের জন্য ছিলো লজ্জার। উম্মে হাবিবার মতো অনুগত স্ত্রী বোধহয় আর কেউ ছিলেন না। তিনি শুধু অনুগতই ছিলেন না, যারা অনুগতো হতো না তাঁদের সাথে ঝগড়া করতেন(১৪১)। রামালাহ ওরফে উম্মে হাবিবা আনুমানিক ৬৬৪ সালের দিকে মারা যান যখন খলিফা ছিলেন তাঁর ভাই মুয়াবিয়া। অন্য স্ত্রীদের সাথে তাঁকেও জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়।
নবী মুহাম্মদের প্রেমে পড়েছিলেন আরোও একজন নারী। কিন্তু তাঁর কথা লেখার আগে লিখতে হবে আরেক হতভাগিনী ইহুদি রাজকন্যার কথা। তাঁর কথা লেখার সময় কতোটুকু অশ্রু ঝরবে আমি জানিনা !
তথ্যসুত্রঃ
(১৩৬)তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস),পৃষ্ঠা ১৭৬-৮০, , ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৫৮৯।
(১৩৭)তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), টিকা ৮০০।
(১৩৮) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ১১০, টিকা ৪৬৬।
(১৩৯) তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৪, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৫৪৩।
(১৪০) সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫১০১, ৫১০৬, ৫১০৭, ৫১২৩, ৫৩৭২; মুসলিম হাদীস নং ১৪৪৯)
(১৪১) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৬৮-৭১, ১৫৩।

প্রিন্সেস_সাফিয়া, সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাবঃ


সাফিয়ার গল্প যদি তাঁর বিয়ের তিন বছর আগে থেকে না শুরু করি তাহলে সাফিয়ার প্রতি অবিচার করা হবে। সাফিয়া বিনতে হুয়াই ছিলেন মদীনার অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী গোত্রের প্রধানের আদুরে রাজকন্যা। তাঁর বাবা ছিলেন বনু নাদির গোত্রের নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব ও মা ছিলেন বনু কোরায়জা গোত্রের বারাহ বিনতে সামওয়াল।
এ গল্পের শুরু একটি শোধ-প্রতিশোধের রক্তাক্ত ঘটনা-প্রবাহ দিয়ে যখন সাফিয়ার বয়স সবেমাত্র চৌদ্দ। হিজরতের চার বছর পরে অর্থাৎ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসকে পাঠান বনু লিহায়েন গোত্রের নেতা খালেদ বিন সুফিয়ানকে হত্যার উদ্দেশ্যে। হত্যার কারণ ছিলো, নাখলা এবং উরানাহ অভিযানের সময় খালেদ মানুষকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছেন। নবীর আরো ভয় ছিলো খালেদ মদীনা আক্রমণ করতে পারেন।
‘আবদুল্লাহ ইবনু উনাইস (রাঃ) হতে তাঁর পিতার সূত্রে থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে খালিদ ইবনু সুফয়ান আল-হুযালীকে হত্যা করার জন্য উরানাহ ও ‘আরাফাতের নিকটে পাঠালেন। বর্ননাকারী বলেন, আমি তার সন্ধান পেলাম ‘আসর সলাতের ওয়াক্তে। আমি আশংকা করলাম আমার এবং তার মধ্যে যদি এখনই সংর্ঘষ বেঁধে যায় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে আমার সলাত বিলম্ব হবে। কাজেই আমি হাঁটতে থাকলাম এবং তার দিকে মুখ করে ইশারায় সলাত আদায় করতে থাকলাম। আমি তার নিকটবর্তী হলে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো , তুমি কে? আমি বললাম , আরবের এক ব্যক্তি। আমার কাছে সংবাদ পৌছেছে যে, তুমি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করছো? সুতরাং আমি এজন্যই তোমার কাছে এসেছি। সে বললো, আমি এরুপই করছি। বর্ননাকারী বলেন, অতঃপর আমি তার সঙ্গে হাঁটতে থাকলাম এবং সুযোগ বুঝে আমার তরবারী দিয়ে তার উপরে আঘাত হানলাম। অবশেষে সে ঠান্ডা হয়ে গেলো ( অর্থ্যাৎ মৃত্যুবরণ করলো)(১৪২)।
হাদীস গবেষকরা এই হাদীসকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও আমরা অনুরূপ ঘটনা মুসনাদে আহমদ ও ইবনে হিশামের নোটে পাই। ইবনে হিশামের বর্ণনানুসারে, আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস এই গুপ্ত হত্যায় সফল হন এবং খালেদের কাটা মুণ্ডু নিয়ে নবীজির কাছে ফেরত আসেন (১৪৩) । এই ঘটনার জের ধরেই পরবর্তীকালে জন্ম নেয় আল রাজী ও বীর মাউনা ট্র্যাজেডি।
উহুদ যুদ্ধের চার মাস পরে বনু আমর গোত্রের আবু বারা নবী মুহাম্মদের জন্য কিছু উপহারসামগ্রী নিয়ে যান। মুহাম্মদ বলেন, “আমি মুশরিকদের কাছ থেকে কোন উপহার গ্রহণ করি না। তুমি যদি মুসলিম হও তাহলে আমি উপহার করবো। এরপর তিনি ইসলামের গুণাগুণ বর্ণনা করেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করেন। যদিও আবু বারা ইসলাম গ্রহণ করেননি কিন্তু বলেন, “আমি আপনার কথায় মুগ্ধ, আপনি যদি কিছু লোক আমার এলাকায় পাঠান তাহলে আমার গোত্রের লোকেরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।“ তখন নবী বলেন, “আমার ভয় হয় যদি তাঁদের কোন ক্ষতি হয়?”
আবু বারা বলেন, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো, তাঁদের কোন ক্ষতি হবে না।“ তখন নবী প্রায় ৪০ থেক ৭০ জন সাহাবী পাঠান যারা কুরআনে বিশেষজ্ঞ ছিলেন (১৪৪)। কিন্তু মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বীর মাউনা নামক স্থানে একদল সশস্ত্র যোদ্ধা তাঁদের আক্রমণ করে এবং নির্মম ও নৃশংস ভাবে সবাইকে হত্যা করে। এই ম্যাসাকারের প্রধান কারণ ধরা হয় খালিদের হত্যা। শুধুমাত্র কা’ব ইবনে জাইয়েদ গুরুতর আহত অবস্থায় জীবিত থাকেন এবং আমর ইবনে উমাইয়া বন্দী হন এবং পরবর্তীতে মুক্তি পান। ইমাম বুখারীর হাদীসে আমরা এই ঘটনার উল্লেখ পাই,
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন এক প্রয়োজনে সত্তরজন সাহাবীকে পাঠালেন, যাদের ক্বারী বলা হত। বানী সুলায়ম গোত্রের দুটি শাখা-রিল ও যাকওয়ান বি’রে মাউনা নামক একটি কুপের নিকট তাদেরকে আক্রমন করলে তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা তোমাদের সঙ্গে লড়াই করার উদ্দেশে আসিনি। আমরা তো কেবল নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশিত একটি কাজের জন্য এ পথ দিয়ে যাচ্ছি। তখন তারা তাদেরকে তাদেরকে হত্যা করে ফেলল। তাই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মাস পর্যন্ত ফজরের সলাতে তাদের জন্য বদদু‘আ করলেন। এভাবেই কুনূত পড়া শুরু হয়। এর পূর্বে আমরা কুনূত পড়িনি। ‘আবদুল ‘আযীয (রহঃ) বলেন, এক ব্যক্তি আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, কুনূত কি রুকূর পর পড়তে হবে, না কিরাআত শেষ করে পড়তে হবে? উত্তরে তিনি বললেন, না বরং কিরাআত শেষ করে পড়তে হবে (১৪৫)।
বীর মাউনার ঘটনা মুসলমানদের জন্য ছিলো প্রচন্ড বড় একটা ধাক্কা। মুহাম্মদ এই ঘটনায় ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। তিনি আমর বিন উমাইয়াকে বীর মাউনাহর ঘটনা তদন্ত করতে পাঠান। তিনি ভুলক্রমে বনু আমর গোত্রের দুজন লোককে হত্যা করে ফিরে আসেন। নবী তাঁদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে বনু আমর গোত্রকে নিরাপত্তা দিবেন। কিন্তু যেহেতু দুইজন লোককে ভুল্ক্রমে মেরে ফেলেছেন এজন্য রক্তমূল্য দিতে হবে। রক্তমূল্য হচ্ছে হত্যার ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ। নবী তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবী উমর, আলি এবং আবু বকরের সাথে শলাপরামর্শ করে বনু নাদির নামক একটি ধনী ইহুদী গোত্রের কাছে গেলেন এবং তাঁদেরকে বললেন, “তোমরা আমাদের পক্ষ থেকে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাও”। এখানে উল্লেখ্য বনু নাদির গোত্রের তখনো কোন কিছুর মধ্যে ইনভলভমেন্ট ছিলো না। তবুও শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে উত্তরে তাঁরা বলেন, “আপনি যেরকমভাবে যা চান ঠিক সেটাই হবে।“ তখন গোত্রের লোকেরা তাঁদেরকে তাঁদের বাড়ির একটি দেয়ালের নীচে বসতে বললো। এখানে উল্লেখ্য রক্তমূল্যপ্রার্থী বনু আমর আর বনু নাদির ছিলো দুই বন্ধু গোত্র। ঠিক এই সময় নবী জিব্রাঈলের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে, বনু নাদির গোত্র অর্থ তো দিবেই না, উল্টো বনু আমর গোত্রের সাথে শলাপরামর্শ করে আল্লাহর নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে।
তখন নবী দ্রুত মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। মদীনায় এসে নবী সবাইকে এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেন এবং সবাইকে নিয়ে বনু নাদির গোত্র আক্রমণ করেন। বনু নাদির গোত্রের লোকজন তখন প্রাণভয়ে দুর্গে আশ্রয় নেয় ।
আল্লাহর নবী তখন সাহাবীদেরকে নির্দেশ দেন তাঁদের খেঁজুর গাছগুলো কেটে ফেলার জন্য। তখন বনু নাদির গোত্রের লোকেরা হায় হায় করে উঠে। তাঁরা চীৎকার করে বলে, “হে মুহাম্মদ আপনি না বলেন কারোও সম্পত্তি নষ্ট করা ভীষণ অন্যায় ও গোনাহর কাজ? এখন আপনি কেন নিজেই এরকম করছেন (১৪৬)?”
ঠিক তখনই সূরা হাশরের ৫ নম্বর আয়াত নাজিল হয়,
“তোমরা যে কিছু কিছু খর্জূর বৃক্ষ কেটে দিয়েছ এবং কতক না কেটে ছেড়ে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই আদেশ এবং যাতে তিনি অবাধ্যদের লাঞ্ছিত করেন (১৪৭)।“
আল্লাহর নবী ১৫ দিন তাঁদেরকে ঘেরাও করে রাখেন। তাঁরা চূড়ান্ত অসহায় ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাঁরা কাতর হয়ে নবীর কাছে প্রাণভিক্ষার আকুতি জানায়।
তখন নবীর মনে একটু দয়া হয়। তিনি তখন উটের পিঠে বহনযোগ্য পরিমাণ জিনিসপত্র(কোনপ্রকার অস্ত্রবিহীন) নেয়ার অনুমতি দিয়ে তাঁদের সেখান থেকে বিতাড়ণ করেন। তাঁদের কেউ যায় সিরিয়ায়, কেউ যায় খায়বারে।
বিতাড়িত লোকদের যে অংশ খায়বারে যায় সে অংশের নেতৃত্বে ছিলেন হুয়াই ইবনে আখতাব, সাফিয়ার বাবা। উটের পিছনে তাঁদের বসবাসের জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে রওনা দেন। বিশাল বহরের পিছনে ছিলো তাঁদের গোত্রের গায়িকারা। তাঁরা খঞ্জন ও বাঁশিতে করুণ সুর বাজাতে বাজাতে খায়বারের পথে যেতে থাকে (১৪৮)।
এই সেই হুয়াই ইবনে আখতাব যিনি খন্দকের যুদ্ধে বনু কোরায়জা গোত্রকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্ররোচিত করেন। এরপর ব্যর্থ হলে পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে বনু কোরায়জার দুর্গের ভিতরেই অবস্থান করেন এবং ফলস্বরূপ সেই ৬০০-৯০০ মানুষের সাথে তাঁকেও জবাই করা হয়।এই ঘটনার সময় সাফিয়ার বয়স ছিলো ষোল। মাত্র ষোল বছর বয়সেই সাফিয়া তাঁর বাবা ও তাঁর মায়ের পক্ষের সকল পুরুষ আত্মীয়কে হারান এবং সকল মহিলা ও এবং শিশু আত্মীয়রা দাসে পরিণত হয় যা আমরা রাহহানার পর্বে জেনেছি (পর্ব আট)।
কুরাইশদের সাথে হুদাইবিয়ার সন্ধির অন্যতম প্রধান শর্ত ছিলো দশ-বছরের যুদ্ধবিরতি। সুতরাং নবী তখন খায়বারের ইহুদীদের দিকে নজর দেন। বনু নাদির গোত্রের অধিকাংশ লোক তখন খায়বারে আশ্রয় নিয়েছিলো। তাঁদের ভিটেমাটি বিতাড়নের থেকে প্রতিশোধ হিসেবে তাঁরা খন্দকের যুদ্ধে বেশ ভালো ভালো অবদান রেখেছিলো। তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক, ২০০০ সৈন্য ও ৩০০ জন অশ্বারোহী পাঠায়। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশ ও ইহুদীদের সম্মিলিত বাহিনীর ব্যর্থতার কথা আমরা রায়হানার পর্বে জেনেছি। নবী যখন খায়বার আক্রমণের পরিকল্পনা করেন তখন তাঁরা ঘাতাফান (খন্দক যুদ্ধে কুরাইশদের মিত্রপক্ষ) ও খায়বারের মাঝখানে একটা জায়গায় যাত্রাবিরতি নেন যেন ঘাতাফান ও খায়বার একসাথে মিলিত হয়ে আক্রমণ করতে না পারে। খবর পেয়ে ঘাতাফান গোত্র সৈন্য সামন্ত নিয়ে একদিনের পথ অতিক্রম করার পর গুজব শুনতে পায় যে মুসলমানরা তাঁদের বাড়িঘর আক্রমণ করছে। খবর পেয়ে তাঁরা ফিরে যায় এবং তখন মুসলমানদের জন্য খায়বার আক্রমণ করা আরোও সহজ হয়।
প্যালেস্টাইনের নির্যাতিত মুসলিমরা মাঝে মাঝে একটি বিশেষ স্লোগান দেন,
خيبر خيبر يايهود جيش محمد سوف يعود
“খায়বার খায়বার ইয়া ইয়াহুদ, জায়শ মুহাম্মদ সাওফা-ইয়াউদ”
যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “খায়বার খায়বার হে ইহুদীগণ, শীঘ্রই আসবে মুহাম্মদের সেনাদল।“
কি হয়েছিলো খায়বারে? যে ইতিহাস মনে করে এখনও নিরীহ ও নির্যাতিত মুসলিমরা নিজেদের উজ্জীবিত করে? খায়বার ছিলো তৎকালীন ইহুদিদের সবচেয়ে বড় জনবসতি। তাঁদের ছিলো আটটি বড় বড় দুর্গ এবং পাশে ছিলো আগ্নেয়গিরি। বলা হয়ে থাকে দুর্গগুলো ছিলো প্রায় অভেদ্য। কুরাইশ ও ঘাতাফান পথ থেকে সরে যাওয়ার পর নবী খায়বারের দিকে আগাতে থাকেন এবং একে একে খায়বারের দুর্গগুলো আক্রমণ করতে থাকেন। সেই বর্ণনায় যাবার আগে খায়বারের দুর্গগুলোর একটি ভিডিও দিলাম যেন পড়ার সময় পাঠকের চোখের সামনে সেই দৃশ্য সহজে ভেসে আসে (১৪৯) ।
খায়বারের ইহুদীদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো, তাঁরা সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের আক্রমণ করেনি। তাই সংখ্যায় অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের রণকৌশলের কাছে তাঁরা ধরাশয়ী হয়। নবী নাইম দুর্গ দিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। আক্রমণকালে তিনি সেই পুরনো কৌশল অবলম্বন করেন। আল হুবাব বিন আল মুনধির নামের এক সাহাবী নবীজিকে পরামর্শ দেন যেহেতু খায়বারের লোকেরা খেঁজুর গাছগুলোকে নিজের প্রথম সন্তানদের চেয়েও ভালোবাসেন সেহেতু এই গাছগুলো কেটে ফেলেন। সাহাবীরা অতি দ্রুততায় প্রায় ৪০০টি গাছ কেটে ফেলেন। তখন আবু বকর এসে অনুরোধ করেন গাছ না কাটার জন্য। কারণ আল্লাহ তো সূরা ফাতহতে বলেই দিয়েছেন যে বিজয় সুনিশ্চিত । (ষষ্ঠ পর্ব, উম্মে সালামা)। তখন নবী মুহাম্মদ গাছ কাঁটা বন্ধের নির্দেশ দেন (১৫০)।
নাইম দুর্গের লোকজন বেড়িয়ে আসলে নবী তাঁদের খুব সহজেই পরাজিত করেন। নাইম দুর্গ জয় করে এরপর আল সাব বিন মুয়াধ দুর্গ আক্রমণ করেন। সে দুর্গ থেকে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে বার্লি, খেঁজুর, ঘি, মধু, তেল, মাংস, পরিধেয় বস্ত্র, পিতল, মাটি ও কাঁচের পাত্র, ভেড়া, গবাদিপশু, গাঁধা ও প্রায় এক হাজার পাঁচশো টুকরো মখমল।
নবী এরপর যখন একের পর এক দুর্গ দখল করতে থাকেন তখন আল-নাইম, আল সাব বিন মুয়াধ ও নাটায় অবস্থিত অন্যান্য দুর্গের মানুষজন কালাত আল জুবায়ের নামের একটি দুর্গম দুর্গে আশ্রয় নেয়। মুসলিমদের জন্য দুর্গে প্রবেশ করা ছিলো কঠিন, কারণ এটি ছিলো পাহাড়ের চুড়ায়। নবী প্রায় তিনদিন দুর্গ ঘেরাও করে রাখেন এবং তাঁদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এমন সময় ঘাজ্জাল নামের এক ইহুদী লোক এসে নবী মুহাম্মদকে বলে, “আপনি যদি আমার ও আমার পরিবারের নিরাপত্তা প্রদান করেন তাহলে আমি একটি মূল্যবান তথ্য দিতে পারি। নবী প্রতিশ্রুতি দিলে সে তখন বলে, আপনারা যদি একমাসও এই দুর্গ ঘেরাও করে রাখেন তবে তাঁদের কিছু হবে না, কারণ তাঁদের একাধিক ভূগর্ভস্থ পানির উৎস আছে। তাঁরা রাতের বেলা পানি সংগ্রহ করে আবার ফিরে যায়, কিন্তু রাস্তাটি আপনাদের জন্য দুর্গম। আপনি যদি পানির সকল উৎস বন্ধ করে দিতে পারেন তাহলে তাঁরা বের হতে বাধ্য। পরামর্শ অনুসারে নবী তখন পানির উৎসগুলো খুঁজে বের করেন এবং সবাই মিলে সেই উৎসগুলোর প্রবাহ বন্ধ করে দেন।
পানির অভাবে তাঁরা যখন আর থাকতে পারে না তখন তাঁরা যুদ্ধ করার জন্য দুর্গ থেকে বের হয়ে আসে এবং যুদ্ধে তাঁরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
এরপর নবী আল শিইকে গমন করেন এবং উবাই দুর্গ , সুমরান দুর্গ দখল করেন। ইহুদীরা তখন পালিয়ে আল নিযার দুর্গে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন দুর্গে বাকি যারা বেঁচে ছিলো তারাও আল নিযার দুর্গে চলে আসে। কালত আল জুবায়ের দুর্গ থেকেও অনেকে পালিয়ে আসে। আল নিযার যুদ্ধও খায়বারের সর্বশেষ যুদ্ধ এবং এখানেও ইহুদীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এই দুর্গের ভেতরেই ছিলেন সাফিয়া।এখান থেকেই সাফিয়া ও তাঁর দুই কাজিনকে বন্দী করা হয়। সাফিয়ার স্বামী কিনানা আল রাবি ভেবেছিলেন আল নিযার দুর্গ সবচেয়ে শক্তিশালী। এইজন্যই হয়তো তিনি সাফিয়াকে সেই দুর্গে রেখেছিলেন।
অপরদিকে ইহুদীদের বাকী সমস্ত নারী ও শিশুকে স্থান্তরিত করা হয়েছিলো আল কাতিবার আল কামুস দুর্গে। কিনানা নিজেও তখন কাতিবায় অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি তাঁর স্ত্রী সাফিয়ার বন্দী হওয়ার খবর পান। আল কামুস দুর্গে প্রায় দুইহাজার ইহুদী ছিলো। কিনানা যখন দেখলেন যে পরাজয় অনিবার্য তখন চিন্তা করলেন কিভাবে রক্তপাত এড়ানো যায়। তিনি তখন নবীর কাছে নিরাপত্তার আকুতি জানান। নবী তাঁদের এই শর্তে নিরাপত্তা প্রদান করেছিলেন যে তাঁরা যেন তাঁদের পরিধেয় বস্ত্র আর অলংকার ছাড়া যত সোনা, রুপা, অস্ত্র, ও দ্রব্যসামগ্রী মুসলিমদের হাতে সমর্পণ করেন (১৫১)।
এরপর নবী মুহাম্মদ সাফিয়ার স্বামী কিনানা আল রাবির সাথে একটি শান্তি চুক্তি সাক্ষর করেন। চুক্তির প্রস্তাব ছিলো,
ইহুদীরা তাঁদের যাবতীয় সম্পদ, সোনা, রুপা আসবাবপত্র মুসলমানদের কাছে রেখে খায়বার ও তাঁর আশেপাশের অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবে, বিনিময়ে মুসলিমরা দুর্গের ভিতরে অবস্থিত কাউকে হত্যা করবে না (১৫২)।
অবশ্য পরবর্তীতে এই শর্ত কিঞ্চিৎ শিথিল করা হয়েছিলো। ইহুদীদের এই শর্ত দেয়া হয়েছিলো তাঁরা সেখানে থাকতে পারবে এবং চাষাবাদ করতে পারবে এই শর্তে যে তাঁদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক খাজনা হিসেবে দিতে হবে। ইমাম বুখারীর বর্ণনায়,
ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
‘উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) ইয়াহূদী ও নাসারাদের হিজায হতে নির্বাসিত করেন। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খায়বার জয় করেন, তখন ইয়াহূদীদের সেখান হতে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। যখন তিনি কোন স্থান জয় করেন, তখন আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুসলিমদের জন্য হয়ে যায়। কাজেই ইয়াহূদীদের সেখান হতে বহিষ্কার করে দিতে চাইলেন। তখন ইয়াহূদীরা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অনুরোধ করল, যেন তাদের সে স্হানে বহাল রাখা হয় এ শর্তে যে, তারা সেখানে চাষাবাদে দায়িত্ব পালন করবে আর ফসলের অর্ধেক তাদের থাকবে। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বললেন, আমরা এ শর্তে তোমাদের এখানে বহাল থাকতে দিব যতদিন আমাদের ইচ্ছা। কাজেই তারা সেখানে বহাল রইল। অবশেষে ‘উমার (রাঃ) তাদেরকে তাইমা ও আরীহায় নির্বাসিত করে দেন (১৫৩)।
এরপর নবী কিনানাকে বলেন, তুমি যদি আমার কাছ থেকে কিছু গোপন করো তাহলে কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর নবী এর পরিণামের দায় নিতে পারবেন না। এরপর যাবতীয় অর্থ -সম্পদ কুঠিগ্রস্থ করেন। অস্ত্রের মধ্যে ছিলো প্রায় ১০০ বর্ম, ৪০০ তরবারি, ১০০০ বর্শা, ৫০০ ধনুক ও অগণিত ধনুকের তীর।
কিনানার পরিবারে প্রচুর পরিমাণ অলংকার ও সোনা-রুপা ছিলো। এগুলো ছিলো তাঁর পরিবারের আভিজাত্যের প্রতীক। তাঁদের সম্পদ সম্পর্কে মদিনার প্রায় সবাই অবগত ছিলো। নবী তখন তাঁকে সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে তিনি বলেন, “আমার যা কিছু আছে সব আপনাকে দিয়ে দিয়েছি এবং বাকী কিছু সব যুদ্ধে খরচ করে ফেলেছি, আমার কাছে আর অবশিষ্ট কিছু নেই।“ এরপর আল্লাহর নবী আবু বকর, উমর, আলি ও দশজন ইহুদীকে সাক্ষী রেখে এই চুক্তি সাক্ষর করেন যে কিনানার কাছে যদি আর কিছু পাওয়া যায় তাহলে তিনি নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। কিনানা সেই চুক্তিতে সাক্ষর করেন।
এরপর নবী তদন্ত শুরু করেন যে কোন তথ্য বের করতে পারেন কিনা। থালাবা বিন সাললাম নামের এক ব্যক্তি জেরার মুখে বলে দেয় যে সে কিনানাকে প্রতিদিন সকালে একটা বিশেষ জায়গায় ধ্বংসস্তুপের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে, কিছু থাকলে সেই জায়গায় থাকতে পারে। এরপর নবী আল জুবায়েরের সঙ্গে থালাবাকে সেই জায়গায় পাঠান। সেখানে মাটি খুঁড়ে কিনানার ধনভান্ডার আবিষ্কৃত হয়। একটি উটের চামড়ার থলের মধ্যে বেশকিছু অলংকার লুকানো ছিলো। তখন নবী জুবায়েরকে কিনানার কাছে পাঠান, এবং নির্যাতন করে আরো তথ্য বের করতে বলেন। জুবায়ের তখন কিনানাকে ধরে নিয়ে আসেন। কিনানার হাত পা বেঁধে, কাঠের মধ্যে আগুন ধরিয়ে জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে কিনানার বুকের মধ্যে খোঁচাতে থাকেন। জীবিত অবস্থাতেই বুকের চামড়া ও মাংস পুড়তে থাকে। এই নির্যাতনের ফলেই সাফিয়ার স্বামী কিনানার মৃত্যু হয়। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন যে এই নির্যাতনের পরেও কিনানা বেঁচে ছিলেন। মুসলামা নামের আরেক সাহাবী তখন কিনানার শিরোচ্ছেদ করেন (১৫২ )।
উটের চামড়ার থলের মধ্যে যেসব অলংকার পাওয়া যায় তা হচ্ছে সোনার ব্রেসলেট, চুড়ি, নুপুর, গলার হাঁর ও কানের দুলসহ নানা অলংকার সামগ্রী। পরবর্তীতে সাফিয়ার বর্ণনায় জানা যায় কিনানা এর মধ্যে কিছু অলংকার সামগ্রী গচ্ছিত করে রেখেছিলেন ভবিষ্যত কন্যাদের জন্য।
কিনানাকে হত্যা করার পর আল্লাহর নবী সাফিয়াকে নিয়ে আসতে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলালকে পাঠান। বেলাল তাঁদেরকে মৃতদেহগুলোর পাশ দিয়ে নিয়ে আসেন। আশে-পাশে আপনজনদের বিকৃত লাশ পড়ে থাকতে দেখে সাফিয়ার কাজিন আর্তনাদ করে উঠেন। তিনি বিলাপ করতে থাকেন, মাথা চাপড়াতে থাকেন ও মাথা ধূলোবালি ছিটাতে থাকেন। এই ঘটনা নবী জানলে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হন। তিনি বেলালকে তিরস্কার করে বলেন,
“তোমার কি বিচার বিবেচনা সব লোপ পেয়েছে যে তুমি এঁদেরকে এভাবে নিয়ে এসেছো?" বেলাল উত্তরে বললেন, “আমি বুঝতে পারিনি বিষয়টি আপনি অপছন্দ করবেন। এঁদেরকে তাঁদের নিকটাত্মীয়দের পরিণতি দেখাতে চেয়েছিলাম।“ তখন নবী, নারীদেরকে বলেন, “তোমরা কিছু মনে করো না, এ একটা শয়তান (১৫২)।“
খায়বারের যুদ্ধের পরে মুসলিমরা বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। সাফিয়ার পরিবার থেকে নবী এতো সম্পদ পেয়েছিলেন যে তিনি, তাঁর স্ত্রীগণ ও তাঁদের উত্তরাধিকারদের অনেকেই আজীবন এই সম্পদ ভোগ করেছেন। খায়বারের গণিমতের বিস্তারিত বিবরণ ইবনে ইশাকের সীরাতেই উল্লেখ আছে (১৫৪)।
সাফিয়া প্রথমে দিহায়া আল কালবির ভাগে পড়েন। সতের বছর বয়সী অনিন্দ্য সুন্দরী সাফিয়াকে দেখে নবী মুগ্ধ হন। এরপর নবী তাঁকে নিজের জন্য পছন্দ করেন এবং দিহায়াকে সাফিয়ার কাজিনকে দিয়ে দেন। এরপর নবী রায়হানা ও জুয়াইরিয়ার মতো একই প্রস্তাব দেন এবং বলেন, “দেখো, আমি তোমাকে জোর করবো না, তুমি তোমার নিজের ধর্ম পালন করতে চাইলে পালন করতে পারো, কিন্তু তোমার জন্য আল্লাহ ও রসুলের ধর্মই বেশি মঙ্গলজনক। সাফিয়া সাথে সাথেই সে প্রস্তাবে রাজি হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন আল্লাহর নবী তাঁকে সাথে সাথেই বিয়ে করেন। তাঁর দেনমোহর হয় তাঁর দাসত্বমোচন (১৫২)। খায়বার থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় নবী বাসর করেন।
বুখারীর হাদীসে এসেছে,
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
“তিনি বলেন,নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাইবার ও মাদীনাহ্‌র মাঝে একস্থানে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন যাতে তিনি সফিয়্যাহ (রাঃ)-এর সঙ্গে বাসর করেছেন। আমি মুসলিমদেরকে ওয়ালীমার জন্য দাওয়াত দিলাম। অবশ্য এ ওয়ালীমাতে গোশতও ছিল না, রুটিও ছিল না। কেবল এতটুকু ছিল যে, তিনি বিলাল (রাঃ)-কে দস্তরখান বিছাতে বললেন। তা বিছানো হল। এরপর তাতে কিছু খেজুর, পনির ও ঘি রাখা হল। এ অবস্থা দেখে মুসলিমগণ পরস্পর বলাবলি করতে লাগল যে, তিনি [সফিয়্যাহ (রাঃ)] কি উম্মাহাতুল মু'মিনীনের একজন, না ক্রীতদাসীদের একজন? তাঁরা (আরো) বললেন, যদি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জন্য পর্দার ব্যবস্থা করেন তাহলে তিনি উম্মাহাতুল মু'মিনীনেরই একজন বোঝা যাবে। আর পর্দার ব্যবস্থা না করলে তিনি দাসীদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর যখন তিনি [নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] রওয়ানা হলেন তখন তিনি নিজের পেছনে সফিয়্যাহ (রাঃ)-এর জন্য বসার জায়গা করে দিয়ে পর্দা খাটিয়ে দিলেন (১৫৫)। “
উম্মে সুলালিম বিনতে মিলহান নামের একজন মহিলা সাফিয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেন। আল্লাহর নবী রাতের বেলা যখন সাফিয়াকে নিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকেন তখন আবু আইয়ুব নামের একজন সাহাবী খোলা তরবারী হাতে সারারাত তাবু প্রদক্ষিণ করেন ও পাহারা দেন। সকালে নবী যখন তাঁকে দেখতে পান তখন আইয়ুব “আল্লাহু আকবর” বলে তাকবীর দেন।নবী তখন এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে আইয়ুব বলেন, “আপনি এঁর পিতা,ভাই, মামা-ফুপা, স্বামী ও আত্মীয়দের হত্যা করেছেন, অতি সাম্প্রতিককালেও সে ছিলো কাফির। এজন্য আপনার জন্য আশংকা হচ্ছিলো। তাই পাহারা দিচ্ছিলাম।“ তখন নবী মুচকি হাসেন ও আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, হে আল্লাহ তুমি আইয়ুবকে নিরাপদে রেখো যেভাবে সে আমাকে নিরাপদে রাখতে সারারাত জেগে ছিলো (১৫৬)।“
মজার ব্যাপার হচ্ছে ইসলামে নিয়ম হচ্ছে ইদ্দতকাল চার মাস দশ দিন। কিন্তু নবী নিজেই সেই নিয়ম মানেন নি, না মানার কারণও অজানা। এই ব্যাপারটি ইসলামিক স্কলাররা এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, সাফিয়ার পূর্ববর্তী বিয়ে ইসলাম ধর্মমতে হয়নি, তাছাড়া নবী তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সুতরাং তাঁর বেলায় এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২৩৪ নম্বর আয়াতটি চলুন দেখে নিই,
"তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মারা যায় তাদের স্ত্রীদেরকে চারমাস ১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। ইদ্দত বা এই নির্ধারিত সময় শেষ হবার পর তারা বিধিমত নিজেদের জন্য কোন কাজ করলে (বিবাহ করলে) তাতে তোমাদের (অভিভাবকদের) কোন পাপ হবে না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত (১৫৭)।"
এইখানে চলুন ক্ষনিকের জন্য একটু চোখ দুটি বন্ধ করি। কল্পনা করুন একজন সতেরো বছর বয়সী আরব কিশোরী, তিন বছর আগে ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, এক বছর আগে তাঁর বাবা, ভাইকে ও নিকটাত্মীদের অনেককে হারিয়েছেন, খায়বারে তিন চাচাকে হারিয়েছেন, প্রাণরক্ষার জন্য দুর্গ থেকে দুর্গে পালিয়ে অবশেষে বন্দী হয়েছেন, বন্দী থেকেই স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েছেন, স্বামীর লাশের পাশ দিয়ে যাত্রা করেছে্‌ন, নিকটাত্মীয়দের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ দেখেছেন এবং স্বামীকে হারানোর তিনদিনের মাথায় সেই হত্যাকারীদের প্রধানের সাথে বাসর উৎযাপন করেছেন।
এই বিষয়ে ইসলামিক স্কলাররা এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, সাফিয়া আগেই জানতেন যে তিনিই শেষ নবী, তিনি নবীজিকে স্বপ্নে দেখেছেন, তিনি জানতেন যে তাঁর বাবা ভাই ও স্বামী সবাই অন্যায়ের পক্ষে এবং তিনি নিজেও স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবে কষ্ট পেলেও ইসলামের সান্নিধ্যে এসে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া নবী তাঁকে ইসলাম গ্রহণ করতে জোর করেন নি। নবী এইজন্য সাফিয়াকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন যে একটি সম্ভ্রান্ত আরব গোত্রের রাজকন্যা হয়ে সাধারণ কারো দাসী হওয়া সাফিয়ার জন্য অবমাননাকর। আর নবীর অন্য স্ত্রীদের বিদ্রুপে যখন তিনি কান্নাকাটি করতেন তখন নবী পাশে থেকেছেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলামে ঠিক এভাবে বর্ণনা করা আছে,
“মদিনা যাওয়ার পথে রসুল (সাঃ) সাহবা নামক স্থানে থামলেন। সেখানে বিয়ে উদযাপন করলেন। এরপর সাহবা থেকে রওনা দেয়ার পথে সাফিয়া নবী (সাঃ)এর হাঁটুতে পা দিয়ে নবী (সাঃ) এর উটে উঠলেন। নবী(সাঃ) তাঁর মুখ ঘোমটা দিয়ে ঢেকে দিলেন। সাহাবীরা বুঝতে পারলেন যে সাফিয়া এখন বিবাহিতা। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্যে সাফিয়া এতোই খুশি হলেন যে তিনি তখন আপনজনদের হারানোর শোক মুহূর্তে ভুলে গেলেন (১৫৮)।“
ইসলামিক সোর্স থেকে সাফিয়ার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে যা জানা যায় সেটি হচ্ছে তিনি খুব নরম স্বভাবের ছিলেন, প্রচুর ইবাদতবন্দেগী করতেন এবং কান্নাকাটি করতেন। ইসলামিক সোর্স থেকে আমরা আরো যেটি জানতে পাই সেটি হচ্ছে নবী সাফিয়াকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন এবং মানসিক সাপোর্ট দিতেন। এর ব্যাখ্যায় একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। একদিন নবী ঘরে ফিরে দেখতে পান যে সাফিয়া অঝোরে কাঁদছেন। তখন এর কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি উত্তরে বলেন যে আয়িশা ও হাফসা প্রায়ই তাঁর ইহুদী ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বিদ্রুপ করেন, তিনি সহ্য করতে না পেরে কান্নাকাটি করেছেন। তখন নবী উত্তরে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “এরপর থেকে তুমি বলবে, আমি হারুন (আঃ) ও মুসা (আঃ) এর বংশধর এবং আমার স্বামী সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ (সাঃ) (১৫৯)।
পরবর্তীতে অবশ্য হাফসা-আয়িশার সাথে তাঁর ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় এবং সালামার সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় তিনি হাফসা-আয়িশার পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য তিনি অন্য স্ত্রীদের কাছেও কটু কথা শুনেছেন। একবার একটি যাত্রার সময় তাঁর উট বসে গেলে তিনি জয়নবের কাছে উট ধার চান। জয়নব “এই ইহুদীর সন্তানকে আমি উট ধার দিবো না” বললে সাফিয়া তখন কাঁদতে থাকেন। এতে নবী জয়নবের উপর এতোই রেগে যান যে দুইমাসের বেশি সময় কথা বলা বন্ধ রাখেন, যা আমরা জয়নবের পর্বে জেনেছি। (রেফারেন্স ১০৯)।
খলিফা উমরের শাসনামলে একবার সাফিয়ার এক দাসী উমরের কাছে গিয়ে অভিযোগ করলো যে, সাফিয়ার গা থেকে ইহুদীদের গন্ধ এখনো দূর হয়নি। কেননা তিনি এখনও ইহুদী রীতি অনুসরণে শনিবারকে পবিত্র দিন হিসেবে পালন করেন এবং ইহুদীদের সাথে ভাল আচরণ করেন । উমর তখন সাফিয়াকে ডেকে বিষয়টি জানতে চাইলেন। সাফিয়া তখন বললেন, ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে আমি শনিবার পছন্দ করি না, কিন্তু আমার কিছু ইহুদী আত্মীয় আছে, আত্মীয়তার হক অনুযায়ী তাঁদের সাথে আমি ভালোআচরণ করি । এই জবাবে তখন উমর সন্তুষ্ট হন এবং মজার ব্যাপার সাফিয়া তখন সেই দাসীকে মুক্তি দিয়ে দেন(১৬০)।
খলিফা উসমানের বিদ্রোহের সময়ে তিনি উসমানকে সাহায্য করার যথেষ্ট চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। তিনি উসমানের দুর্গে খাবার ও পানি পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। সম্ভবত ৬৭০ কিংবা ৬৭২ সালে এই চিরদুখিনী ইহুদী রাজকন্যা মৃত্যুবরণ করেন (১৬১)।
যেহেতু সাফিয়ার গল্প নবীস্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে করুণ ও স্পর্শকাতর, সেহেতু পাঠকদের উচিত ইসলামিক স্কলারদের ব্যাখ্যাও শোনা। স্কলারদের মধ্যে সবচেয়ে চমৎকারভাবে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছেন ডঃ ইয়াসির কাদরি। আগ্রহী পাঠকগণ লেকচার শুনে দেখতে পারেন (১৬২)।
অপরদিকে আমি যথেষ্ট হতাশ হয়েছি যখন জাকির নায়েক এই ঘটনা পুরোপুরি চেপে গিয়ে বলেছেন যে সাফিয়ার বিয়ের কারণ ছিলো ইহুদীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন, যা পুরোপুরি মিথ্যা। ৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের পর থেকে শুনে দেখতে পারেন (১৬৩ )।
শিহাবউদ্দিন আহমেদ তুহিন নামের একজন ভদ্রলোক ইসলামিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন এবং বিভিন্ন সমালোচনার জবাব দিয়ে থাকেন। তিনিও সাফিয়ার বিয়ের বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সুতরাং আপনাদের কাছে অনুরোধ প্লীজ প্লীজ আমার লেখাটি পড়ার সাথে সাথে উনার লেখাটিও পড়ে দেখবেন (১৬৪) ।
পরের পর্বে আসবেন নবী মুহাম্মদের পরবর্তী স্ত্রী মায়মুনা। মায়মুনার সাথে কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ জড়িত নেই। কিন্তু ঘরে কুকুর কেন নিষিদ্ধ হলো সেটি জানতে পারবেন পরবর্তী পর্বে।
তথ্যসূত্রঃ
(১৪২) আবু দাউদ, হাদীস নং ১২৪৯।
(১৪৩) ইবনে হিশাম নোট ২/৬১৯।
(১৪৪) তাবারী, সপ্তম খন্ড (দ্য ফাউন্ডেশন অফ দ্য কমুনিটিঃ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ১৫১।
(১৪৫) সহীহ বুখারী হাদিস ৪০৮৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৭৮৫।
(১৪৬) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৪৩৭-৩৯, তাবারী, সপ্তম খন্ড (দ্য ফাউন্ডেশন অফ দ্য কমুনিটিঃ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ১৫৬-১৬১।
(১৪৭) সূরা হাশর, আয়াত ৫।
(১৪৮) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৫১০-১১, তাবারী, অষ্টম খন্ড (দ্য ভিক্টরি অফ ইসলাম), পৃষ্ঠা ১১৬-১৭।
(১৫০) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৫৭০, ইবনে হিশাম নোট নম্বর ৭৭০।
(১৫১) আল ওয়াকিদি, কিতাব আল মাগাজি, পৃষ্ঠা ৩২৭-৩০, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৫১১-১২।
(১৫২) আল ওয়াকিদি, কিতাব আল মাগাজি, পৃষ্ঠা ৩৩০-৩২, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৫১৪-১৫, তাবারী অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম), পৃষ্ঠা ১২১-২৩।
(১৫৩) সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৩৮।
(১৫৪) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৫২১-৫২৩।
(১৫৫) সহীহ বুখারী হাদীস ৪২৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৮৯৫।
(১৫৬) আল ওয়াকিদি, কিতাব আল মাগাজি, পৃষ্ঠা ৩৪৮-৪৯, ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ ), পৃষ্ঠা ৫১৬-১৭।
(১৫৭) সূরা বাকারা আয়াত ২৩৪।
(১৫৮) এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৪।
(১৫৯) তিরমীযী, হাদীস নং ৩৮৯২, সীরাতুন মোস্তফা ৩/৩০৫ ।
(১৬০) সীরাতুন মোস্তফা ৩/৩০৬।
(১৬১) এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ৮১৭।
(১৬৫) ছবিটির উৎস angergeneral.com )


মায়মুনা বিনতে আল হারিথঃ
খাদিজার পর মায়মুনা দ্বিতীয় স্ত্রী যিনি নিজেই নবীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মায়মুনার জন্ম হিলাল নামক একটি মধ্যবিত্ত গোত্রে (১৬৫)। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি তাঁর বোন লুবাবার বাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকা শুরু করেন (১৬৬)। লুবাবার স্বামী আল আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তিনি সুগন্ধীর ব্যবসা করতেন এবং অঢেল সম্পত্তির মালিক ছিলেন (১৬৭)। তিনিই ছিলেন মায়মুনার বিয়ের অভিভাবক। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর ৬২৮ সালের জুলাই মাসের দিকে নবী যখন প্রথম ওমরাহ পালন করতে যান তখন বিধবা মায়মুনা নবী মুহাম্মদকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। নবী মুহাম্মদ সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান। মায়মুনা যখন এই সুসংবাদ পান তখন তিনি উটের পিঠে অবস্থান করছিলেন। শুনে তিনি এতোই খুশি হন যে তিনি উট থেকে নেমে যান এবং ঘোষণা দেন যে এই উট এবং উটের উপরে অবস্থিত সবকিছু আল্লাহর রাসুলের। আল আব্বাসের অভিভাবকত্বে দুজনে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। মায়মুনার পূর্ব নাম ছিলো বারাহ। বিয়ের পর নবী নাম দেন মায়মুনা, যার অর্থ সৌভাগ্যবতী (১৬৮)।
ইবনে ইশাকের বর্ণনানুসারে, সেবার নবী মুহাম্মদ প্রথম মক্কায় ওমরাহ করতে যান। হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে সেখানে তাঁর তিন দিন থাকার কথা ছিলো। তিনদিন পার হওয়ার পর, কিছু কুরাইশ প্রতিনিধি নিয়ে হুয়াইতিব বিন আবদুল উজ্জাহ এসে তাঁকে, বললেন, “তোমার সময় শেষ, এখন আমাদের থেকে বিদায় হও।“ নবী উত্তরে বললেন, “এরকম করলে কেমন হয়, তোমরা আমাকে এখানে থাকতে দাও, আমি তোমাদেরকে আমার বিয়ের ট্রিট দেই?” হুয়াইতিব উত্তর দিলেন, “আমাদের তোমার থেকে কোন খাবার খাওয়ার দরকার নেই, সুতরাং তুমি বরং বিদায় হও।“ নবী তখন বাধ্য হয়ে শরীফ নামক একটি জায়গায় চলে গেলেন এবং অপেক্ষা করলেন যতক্ষণ না আবু রাফি মায়মুনাকে নিয়ে আসেন। সেইখানে তাঁরা বাসর উৎযাপন করেন (১৬৯)।
মায়মুনার বিয়ের পর একটু কানাঘুষা শুরু হলো, নবীর বিয়ে করা নিয়ে। বিশেষ করে আয়িশার মনে প্রশ্ন উঠলো এ কেমন মহিলা যে নিজেই নিজের বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়!
তখন নীচের আয়াতটি নাজিল হয়,
হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল।এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু (১৭০)।
মায়মুনা বেশ দয়াবতী নারী ছিলেন, তিনি তাঁর নিজস্ব দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
বুখারীর বর্ণনানুযায়ী,
মায়মূনাহ বিনতে হারিস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুমতি ব্যতীত তিনি আপন বাঁদীকে মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর তার ঘরে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -র অবস্থানের দিন তিনি বললেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি কি জানেন না আমি আমার বাঁদী মুক্ত করে দিয়েছি? তিনি বললেন, তুমি কি তা করেছ? মায়মূনাহ (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, শুন! তুমি যদি তোমার মামাদেরকে এটা দান করতে তাহলে তোমার জন্য বেশি নেকির কাজ হত ।
অন্য সনদে বাকর ইবনু মুযার (রহঃ) ----কুরায়ব (রহঃ) হতে বর্ণিত যে, মায়মূনাহ (রাঃ) গোলাম মুক্ত করেছেন (১৭১)।
মায়মুনার কাছ থেকেই আমরা আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনতে পারি। যে ঘটনার ভিত্তিতে মদীনায় অসংখ্য কুকরকে হত্যা করা হয়। সহীহ মুসলিমের হাদীসে এসেছে,
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, মাইমূনাহ্ (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, একদিন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিমর্ষ অবস্থায় সকালে উঠলেন। তখন মাইমূনাহ্ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আজকে আপনার চেহারা মুবারাক বিষন্ন দেখছি। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ জিব্রীল (‘আঃ) আজ রাত্রে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। জেনে রাখ আল্লাহ্‌র কসম! তিনি (কক্ষনো) আমার সঙ্গে ওয়া‘দা খিলাফ করেননি। পরে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সে দিনটি এভাবেই কাটালেন। এরপর আমাদের পর্দা (ঘেরা খাট) এর নিচে একটি কুকুর ছানার কথা তাঁর স্মরণ হলো। তিনি নির্দেশ করলে সেটি বের করে দেয়া হলো। অতঃপর তিনি তাঁর হাতে সামান্য পানি নিয়ে তা ঐ (কুকুর শাবক বসার) স্থানে ছিটিয়ে দিলেন। অতঃপর সূর্যাস্ত হলে জিব্রীল (‘আঃ) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। সে সময় তিনি তাঁকে বললেন, আপনি তো গত রাত্রে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে আমরা (ফেরেশ্তারা) সে সকল গৃহে প্রবেশ করি না যে সকল গৃহে কোন কুকুর থাকে। অথবা কোন (প্রাণীর) ছবি থাকে। অতঃপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেদিন সকাল বেলায় কুকুর নিধনের নির্দেশ দিলেন। এমনকি তিনি ছোট বাগানের (পাহারাদার) কুকুরও মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং বড় বড় বাগানের কুকুরগুলোকে মুক্তি দিয়েছিলেন (১৭২)।
মায়মুনার ঘরেই নবী সর্বপ্রথম অসুস্থতা অনুভব করেন এবং অন্তিম দিনগুলো আয়িশার ঘরে কাটানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। মায়মুনা নবীর সাথে মাত্র তিন বছর সংসার করতে পেরেছিলেন। নবী মুহাম্মদের অধিকাংশ স্ত্রীর কবর জান্নাতুল বাকীতে। কিন্তু মায়মুনার অনুরোধে মায়মুনাকে শরিফে সমাহিত করা হয়, সেই স্থানে যেখানে নবীর সাথে বিয়ে এবং বাসর হয়েছিলো।
নবীর জীবনের শেষদিকের বিয়ে হওয়ায় মায়মুনা সম্পর্কে আর বেশি কিছু জানা যায় না। এরপরে যার গল্প আসবে, অর্থাৎ মারিয়া কিবতিয়া, তাঁর গল্প আমরা হাফসার পর্বে অনেকখানিই জেনেছি। বাকী আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য আসবে পরবর্তী পর্বে!
তথ্যসূত্রঃ
(১৬৫) তাবারী, নবম খন্ড (দ্য লাস্ট ইয়ারস অফ দ্য প্রফেট, ১৩৫, ইবনে হিশাম নোট ৯১৮।
(১৬৬) ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ৯৪।
(১৬৭) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ১১৩-১৪।
(১৬৮) ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮৪-৮৫।
(১৬৯) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৫৩১।
(১৭০) সূরা আহজাব আয়াত ৫০।
(১৭১) সহীহ বুখারী ২৫৯৪।
(১৭২) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৪০৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৩৩৫, ২৩০৫, ৫২৪৮।

মারিয়া বিনতে শামুন আল কিবতিয়াঃ

আলেক্সান্ড্রিয়ার সম্রাট আল-মুকাওকিস নবী মুহাম্মদকে মারিয়া এবং শিরিন নামের দুইজন দাসী ও একজন দাসকে উপঢৌকন হিসেবে পাঠান সে ঘটনা আমরা হাফসার পর্বে জেনেছি। হাফসার পালার দিন হাফসার ঘরে, হাফসার বিছানায় মারিয়ার সাথে সংগমের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নবী মুহাম্মদের সকল স্ত্রী প্রথমবারের মতো একতাবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে সূরা তাহরিমের বেশ কয়েকটি আয়াত নাজিল হয় সেটিও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
মারিয়া ও শিরিনের সাথে পাঠানো সেই দাসের নাম হচ্ছে মাবুর। মাবুরকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য, সে যেন পাহারা দিয়ে মদীনায় পৌঁছে দেয়। মাবুর তার দায়িত্ব পালন করে নবী মুহাম্মদের হাতে দাসী দুজনকে বুঝিয়ে দেয় (১৭৩) ।
নবীর জীবনে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, কোন এক অজানা কারণে খাদিজার মৃত্যুর পর এতোজন স্ত্রীর মধ্যে কেউই গর্ভধারণ করেন নি। কিন্তু নবীর জীবনের শেষের দিকে মারিয়ার গর্ভে নবীর এক পুত্রসন্তান হয়, যার নাম ইব্রাহীম। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে সে বাচ্চা অবস্থায়ই মারা যায়। এবং কাকতালীয়ভাবে ইব্রাহিমের মারা যাওয়ার দিন ছিলো সূর্যগ্রহণের দিন। মক্কার লোকেরা তখন বলাবলি করতে থাকে যে নবীজির ছেলের শোকে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। নবী তখন বলেন যে কারো জন্ম বা মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয় না। ইমাম বুখারীর বর্ণনায়,
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময় একবার সূর্যগ্রহণ হল। তখন আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করেন। তিনি দীর্ঘ সময় কিয়াম করেন, অতঃপর দীর্ঘক্ষণ রুকূ’ করেন। অতঃপর পুনরায় (সালাতে) তিনি উঠে দাঁড়ান এবং দীর্ঘ কিয়াম করেন। অবশ্য তা প্রথম কিয়াম চেয়ে অল্পস্থায়ী ছিল। আবার তিনি রুকূ’ করেন এবং এ রুকূ’ও দীর্ঘ করেন। তবে তা প্রথম রুকূ’র চেয়ে অল্পস্থায়ী ছিল। অতঃপর তিনি সিজদা করেন এবং সিজদাও দীর্ঘক্ষন করেন। অতঃপর তিনি প্রথম রাকা’আতে যা করেছিলেন তার অনুরূপ দ্বিতীয় রাকা’আতে করেন এবং যখন সূর্য প্রকাশিত হয় তখন সালাত শেষ করেন। অতঃপর তিনি লোকজনের উদ্দেশে খুত্‌বা দান করেন। প্রথমে তিনি আল্লাহ্‌র প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ্‌র নিদর্শন সমূহের মধ্যে দু’টি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন তোমরা আল্লাহ্‌র নিকট দু’আ করবে। তাঁর মহত্ব ঘোষণা করবে এবং সালাত আদায় করবে ও সদকা প্রদান করবে। অতঃপর তিনি আরো বললেনঃ হে উম্মাতে মুহাম্মাদী! আল্লাহ্‌র কসম, আল্লাহ্‌র কোন বান্দা যিনা করলে কিংবা কোন নারী যিনা করলে, আল্লাহ্‌র চেয়ে অধিক অপছন্দকারী কেউ নেই। হে উম্মাতে মুহাম্মাদী! আল্লাহ্‌র কসম, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তাহলে তোমরা অবশ্যই হাসতে কম এবং বেশী করে কাঁদতে (১৭৪)।
তবে যে ব্যাপারটি আধুনিক স্কলার রা খুব একটা বেশি তুলেন না সেটি হচ্ছে নবী মুহাম্মদ সন্দেহ করতেন ইব্রাহীম তাঁর নিজের সন্তান নয়। উপরোক্ত বুখারীর হাদীসেই এর ভালো আলামত পাওয়া যায়। কেননা পুত্রের মৃত্যুদিনে তিনি অযাচিতভাবে জেনার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং তিনি কি এমন বিষয় জানেন যেটি উম্মতে মুহাম্মদী জানে না সেটিও মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। মাবুর যেহেতু মারিয়াকে দেখাশোনা করতো এরজন্য সন্দেহের তীর চলে যায় মাবুরের দিকে। তিনি মাবুরের প্রতি এতো বেশি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন যে তিনি তাঁর জামাতা আলীকে পাঠান মাবুরকে হত্যা করতে। মাবুর আলীকে দেখে উদ্দেশ্য বুঝতে পারে এবং সাথে সাথেই নগ্ন হয়ে যায়। আলীকে পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে সে সন্তান জন্মদানে অক্ষম। এরপর আলী তাঁকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন (১৭৩)।
নবীর মৃত্যুর পর মারিয়ার জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। নবীর মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আধুনিক ইসলামিক স্কলারদের অনেকেই রায়হানা এবং মারিয়াকে দাসী হিসেবে স্বীকার করতে চান না। সবসময় এরকম বলা হয়, নবীজির স্ত্রীর সংখ্যা ১৩, মতান্তরে ১১। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আদি সিরাতগ্রন্থগুলোতে সর্বমোট উল্লেখ আছে ২২ জন স্ত্রীর ও ৪ জন দাসীর কথা। এছাড়াও বিয়ের চুক্তি হয়েছিলো ১১ জনের সাথে এবং প্রস্তাব আদানপ্রদান প্রায় আরো ১০ জনে সাথে! সিরাত লেখকরা অভিমত দিয়েছেন এর বাইরেও দু একজন থাকলেও থাকতে পারে! এই তেরজনের বাইরে বাকীদের বর্ণনা খুবই অল্প অল্প করে লেখা আছে। অনেকের ক্ষেত্রে এক দুই লাইন। সম্ভবত এই কারণেই আধুনিক স্কলাররা তেরোজনের বাইরে যেতে চান না। নবীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা চারজন নারীর কথাও কেউ উল্লেখ করেন না কোথাও। কিছু কিছু ঘটনা এতো বেশি বিব্রতকর যে ইসলামের ইতিহাস থেকেই হারিয়ে গেছে চিরতরে!
মেজরিটি পাঠক যদি আগ্রহী হন তাহলে যেখানে যা কুড়িয়ে পাই সবকিছু মিলিয়ে তিন-চার পর্বে লিখে দেবো বাকী অবহেলিত স্ত্রীদের অজানা কাহিনী। সে পর্যন্ত, বিদায়!
প্রথম পর্বের লিংকঃ
তথ্যসুত্রঃ
(১৭৩) তাবারী, নবম খন্ড (দ্য লাস্ট ইয়ারস অফ দ্য প্রফেট, পৃষ্ঠা ১৪৬-৪৭,ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১৫৩।
(১৭৪) সহীহ বুখারী হাদীস নং ১০৪৪।

তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীগণঃ
নবী মুহাম্মদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী-গণের কাহিনী আমাদের বেশিরভাগেরই কাছে অজানা। হাদীসে পাওয়া যায় না। তথ্যের জন্য সিরাত গ্রন্থগুলোই ভরসা। সেখান থেকেই ঠিক যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তারই মূলত অনুবাদ নিয়েই আজকের এই পর্ব।
১। মুলায়কা বিনতে কাবঃ
মক্কা বিজয়ের পরে নবী মুহাম্মদকে খুশি করতে মুলায়কার গোত্র সুন্দরী মুলায়কাকে নবীর হাতে তুলে দেন। মুলায়কা তাঁর নজরকারা সৌন্দর্যের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। ৬৩০ সালের জানুয়ারি মাসে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর আয়িশা মুলায়কাকে গিয়ে বলেন, “তোমার লজ্জা করে না তুমি এমন একজনকে বিয়ে করেছো যে তোমার পিতাকে হত্যা করেছে?” তখন মুলায়কা উত্তর দেন, নবীর কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। (তাবারীর সিরাতে এক্সাকটলি এভাবে কোট করা আছে, “I seek God’s protection against you”) একথা কানে যাওয়ার পরপরই নবী তাঁকে তালাক দিয়ে দেন। তালাকের খবর শুনে মুলায়কার গোত্রের লোকজন দৌড়ে আসে। তাঁরা নবীকে বলে, “সে অনেক ছোট, তাঁর নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, না বুঝে বলে ফেলেছে, ওকে মাফ করে দেন।“ নবীকে বারবার অনুরোধ করার পরও তিনি ফিরিয়ে দেন। এরপর নবীর অনুমতিক্রমে গোত্রের লোকেরা মুলায়কাকে তাঁর গোত্রেরই এক কাজিনের কাছে বিয়ে দিয়ে দেয় (১৭৫)।
২। ফাতিমা আল আলিয়া বিনতে জাবইয়ান আল দাহাকঃ
মুলায়কাকে তালাক দেয়ার খুব অল্পদিনের মধ্যেই নবী ফাতিমাকে বিয়ে করেন। ফাতিমার নাম ও গোত্র নিয়ে বেশ দ্বিমত আছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো নবী বাইরে গেলেই তিনি পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তার মানুষ দেখতেন। নবীর অনান্য স্ত্রীরা এই নিয়ে নবীর কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে নবী বলেন, “তোমরা তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বলছো।“ তখন নবীর স্ত্রীরা বলেন, “ঠিক আছে আমরা আপনাকে দেখাবো।” পরিকল্পনামাফিক সবাই মিলে ফাতিমাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন। ফলস্বরূপ নবী তাঁকে সাথে সাথেই তালাক দেন। শুধু তাই না। এরপর তিনি ফাতিমার গোত্রের আর কাউকে বিয়ে করেন নি (১৭৬)।
আগের বিয়ের মতো এই বিয়েও কয়েক সপ্তাহ টিকে ছিলো। ঐসময় মেয়েদের বাইরে কাজ করার অনুমতি ছিলো, কিন্তু পর্দা করা অবস্থায় কাজ খুব একটা সহজসাধ্য ছিলো না। তিনি পরবর্তী জীবন উটের গোবর সংগ্রহ করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি সবসময় হা-হুতাশ ও আক্ষেপ করতেন, হায় আমি অভাগিনী, হায় আমি হতভাগিনী (১৭৬)।
৩।প্রিন্সেস আসমা, আসমা বিনতে আল-নুমানঃ
ফাতিমাকে তালাক দেয়ার মাস দুয়েক পরে নবী বিয়ে করেন আসমা বিনতে আল-নুমানকে। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের রাজকন্যা। আসমার পরিবার আসমাকে বিয়ে দেয় এই আশায় যেন নবী মুহাম্মদ আত্মীয়তার খাতিরে ইয়েমেন আক্রমণ না করেন।
আসমার পিতা আল-নুমান নবীর কাছে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সেই সাথে প্রস্তাব দেন, “হে আল্লাহর নবী! আপনি কি আরব বিধবাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করতে চান?” নবী রাজী হলে আল-নুমান বলেন, “ঠিক আছে, তাহলে একজন লোক পাঠান আমি আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। নবী আবু উসাইদ আল সাইদীকে পাঠান। আসমা তখন একটি তাঁবুর ভেতরে অপেক্ষা করছিলেন। আবু উসাইদ গিয়ে বলেন, “নবী স্ত্রীদের কোন পরপুরুষকে দেখা দেয়া উচিত না। তখন আসমা জিজ্ঞেস করেন, “কি করতে হবে আমাকে শিখিয়ে দিন।“ তখন আবু উসাইদ পর্দার সব নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেন। আবু উসাইদ তিনদিন পর উটের পিঠে পালকিতে আসমাকে বসিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।
মদিনায় আসার পর আসমার রুপের কথা মদীনার মহিলাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বলাবলি করতে থাকে এরকম সুন্দরী নারী আর দেখিনি। এই কথা শুনে একজন নারী আসমাকে দেখতে আসেন। তিনি বলেন, “তোমার শরীরে রাজরক্ত, তুমি যদি নবীজির কাছে বিশেষ প্রিয়পাত্রী হতে চাও তাহলে তোমাকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিতে পারি, শিখতে চাও?” তখন তিনি খুশিতে বললেন, “অবশ্যই”, তখন সেই অপরিচিত নারী তাঁকে মুকায়লার বলা সেই বাক্যটি শিখিয়ে দিলেন, “আমি আপনার থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।“
এই দোয়া শিখিয়ে দেয়া অপরিচিত নারীটি হচ্ছেন নবী মুহাম্মদের স্ত্রী আয়িশা।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আয়িশা ও হাফসা মিলে আসমাকে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন। এক ফাঁকে দুজনের একজন সেই বাক্যটি শিখিয়ে দিলেন। আসমা যখন বাসর শয্যায় বসে ছিলেন, তখন নবী মুহাম্মদ দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে ঘোমটা তোলার সাথে সাথেই আসমা বলে উঠেন, “আমি আল্লাহর কাছে আপনার থেকে নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।” একথা শোনার সাথে সাথে নবী মুহাম্মদ তাঁর জামার আস্তিন দিয়ে মুখ ঢাকলেন। এরপর বললেন, “তুমি সত্যিই নিরাপত্তা কামনা করেছো। নবী এই কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করার পর বের হয়ে এসে আবু উসাইদকে বললেন, এঁকে দুটি সুতির জামা দাও এবং এরপর এঁকে তাঁর গোত্রে ফেরত দিয়ে আসো।
তিনি যখন তাঁর গোত্রের মানুষের কাছে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তারা বলাবলি করতে লাগলো এই অলুক্ষণে মেয়েটা আবার ফিরে এলো কেন? তখন আসমা বললেন, “আমার কোন দোষ নেই, আমি ধোঁকাপ্রাপ্ত হয়েছি।“ সব শোনার পর গোত্রের লোকেরা বললো, “তুমি সমস্ত আরবের মধ্যে আমাদের গোত্রের দুর্নাম কামিয়েছো।“ তিনি তখন আবু উসাইদকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি এখন কি করবো?” উত্তরে উসাইদ বললেন, “আপনি ঘরের মধ্যে পর্দা করে থাকুন, মাহরাম ছাড়া কারো সাথে দেখা করবেন না, আর আপনি যেহেতু উম্মুল মুমেনীন, নবী মুহাম্মদের পরে আপনাকে কারো বিয়ে করতে চাওয়া উচিত না।“
তিনি ঠিক সেইভাবেই পর্দার অন্তরালে বাকী জীবন কাটিয়ে দেন। খলিফা নাজাদের শাসনামলে তিনি নাজাদ নামক জায়গায় চিরকুমারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (১৭৭)।
৪। আমরা বিনতে ইয়াজিদঃ
আমরা সম্পর্কে এতটুকুই জানা যায় যে বিয়ের পর নবী জানতে পারলেন যে আমরার শ্বেতীরোগ(leprosy) আছে। জানার পর সাথে সাথেই নবী তাঁকে তালাক দিয়ে দেন (১৭৮)।
৫। গাজিয়া বিনতে জাবির (উম্মে শারিক)ঃ
মুহাম্মদ যখন গাজিয়ার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তাঁর শারিক নামের একজন পুত্রসন্তান ছিলো। এজন্য তাঁকে উম্মে শারিক নামেও ডাকা হয়। তাঁর সাথে যখন প্রথম নবীর দেখা হয় নবী বুঝতে পারেন তিনি যতটুকু ভেবেছিলেন গাজিয়া তাঁর থেকেও বয়স্ক। এরপর সাথে সাথেই তিনি গাজিয়াকে তালাক দিয়ে দেন (১৭৯)।
আরো দুইজন উপপত্নীর নাম পাওয়া যায় সিরাতে, তাঁদের একজন জয়নব বিনতে জাহশের দাসী “আল জারিয়া”, আরেকজন বনু কোরায়জা গোত্রের “টুকানা আল কোরায়জা।“ এ দুজনের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি তথ্য আর কোথাও নেই।
এর পরের পর্ব আসবে, যাদেরকে বিয়ে করার কথা ছিলো, যাদের সাথে বিয়ের চুক্তি হয়েছিলো, যাদেরকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, যাদেরকে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং যাদের কাছ থেকে তিনি প্রস্তাব পেয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে।
তথ্যসুত্রঃ
(১৭৫) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৬৫, তাবারী, অষ্টম খন্ড (ভিক্টরি অফ ইসলাম ), পৃষ্ঠা ১৮৭, ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১০৬।
(১৭৬) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮৭-৮৮, ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১০০-০১, ১৫৩।
(১৭৭) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮৮-৯১, ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১০১-০৫, ১৫৩।
(১৭৮) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস), পৃষ্ঠা ১৮৮, ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১০০-০১।
(১৭৯) তাবারী, নবম খন্ড (দ্য লাস্ট ইয়ারস অফ দ্য প্রফেট) পৃষ্ঠা ১৩৯,ইবনে সা’দ, অষ্টম খন্ড (দ্য উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১১-১৪।


ফাখিতাহ বিনতে আবি তালিব (#উম্মে হানী)ঃ
ইসলামের ইতিহাসে একটি বিস্মৃত নাম ফাখিহাহ বিনতে আবি তালিব ওরফে হিন্দ ওরফে উম্মে হানী। ফাখিতাহ ছিলেন নবীর আপন চাচা আবু তালিবের মেয়ে। আলি এবং ফাখিতাহ ছিলেন আপন-ভাইবোন। ফাখিতাহর অপর আরেকটি নাম হিন্দ হলেও তিনি উম্মে হানী (হানীর মা) নামেই সর্বাধিক পরিচিত। নবুয়ত প্রাপ্তির অনেক আগে,খাদিজাকে বিয়েরও পূর্বে নবী মুহাম্মদ ফাখিতাহকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু চাচা আবু তালিব মুহাম্মদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিয়ে দেন ধনী মাখজুম গোত্রের হুবায়রা ইবনে আবি ওয়াহাবের কাছে। মুহাম্মদ তখন চাচাকে জিজ্ঞেস করেন, “আমার কাছে বিয়ে না দিয়ে কেন হুবায়রার কাছে বিয়ে দিলেন?” উত্তরে আবু তালিব বলেন, “ভাতিজা, তাঁরা এখন আমাদের আত্মীয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাথে সম্পর্ক সম্ভ্রান্ত পরিবারেরই হয়।“ এখানে উল্লেখ্য হুবায়রা ছিলেন সেই সময়ের একজন প্রখ্যাত কবি (১৯৮)।
৬১৯-২০ সালের দিকে খাদিজা ও আবু বকর মারা যান। সবচেয়ে কাছের দুই মানুষকে হারিয়ে নবী তখন তীব্র বেদনায় কাতর। তিনি এরপর সাওদা আর আয়িশাকে বিয়ে করলেও তখনো আয়িশাকে ঘরে তুলে নেননি। তখন বাড়িতে তাঁর ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতেন স্ত্রী সাওদা। এসময় নবী মুহাম্মদ বেশিরভাগ সময়ই কাবাঘরে ইবাদাত বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। কাবার খুবই কাছে ছিলো উম্মে হানির বাড়ি । তিনি মাঝেমধ্যেই তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। বাবা আবু তালিবের মতোই উম্মে হানি ইসলাম গ্রহণ না করলেও তাঁর সাথে নবী মুহাম্মদের সুসম্পর্ক ছিলো।
এই উম্মে হানির ঘর থেকেই নবী মিরাজে গমন করেন। সময়টি ছিলো ৬২১ খ্রীস্টাব্দ। উম্মে হানি এ প্রসঙ্গে বলেন, “তিনি আমার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থেকে মিরাজে গমন করেন নি। সেরাত্রে তিনি আমার বাড়িতেই রাতে ঘুমান। এশার নামাজ পড়ে তিনি যখন ঘুমান তখন আমরাও ঘুমিয়ে যাই। ভোর হওয়ার কিছু আগে তিনি আমাদের জাগিয়ে তুলেন, যখন আমরা ভোরের প্রার্থনা (morning prayer as per ibn ishaq) করলাম তখন তিনি বললেন, হে উম্মে হানি, তুমি আমাকে এখানে রাতে নামাজ পড়তে দেখেছো। এরপর আমি জেরুজালেম যাই এবং সেখানে নামাজ আদায় করি। আর এখন তো দেখতেই পারছো তোমাদের সাথে ফজর আদায় করলাম। তিনি বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই আমি তাঁর জামা টেনে ধরলাম। আমি তাঁকে বললাম, “হে আল্লাহর নবী, এই ঘটনা কাউকে বলবেন না, তাহলে তাঁরা আপনাকে মিথ্যেবাদী বলবে এবং অপমান করবে। তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর কসম, “আমি অবশ্যই বলবো।“ এরপর তিনি বের হয়ে গেলেন। আমি সাথে সাথে আমার আফ্রিকান দাসীটিকে পাঠালাম দেখার জন্য যে উনি কি বলেন, আর লোকজন কি প্রতিক্রিয়া দেখায় (১৯৯)।“
এখানে উল্লেখ্য, যেহেতু মিরাজের আগে নামাজের হুকুম আসেনি এবং উম্মে হানীও ইসলাম গ্রহণ করেছেন অনেক পরে, তাই এই নামাজ বা প্রার্থনার বিষয়টি আমার নিজের কাছেই অস্পষ্ট।
ইবনে কাছিরের তাফসীরে, সূরা বনি-ইসরাইলের প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় মিরাজের ঘটনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে। এই ঘটনায় এতো বেশি হাদিস আছে যে সবগুলো আলাদা আলাদা না লিখে সবগুলো হাদীসের সমন্বয়ে ঘটনা সংক্ষেপে লিখছি। পুরো ঘটনাই নবীর মুখ থেকে শোনা এবং সাহাবীদের প্রচার করা।
নবী যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন ফেরেশতা জিব্রাইল এসে তাঁকে তুলে জমজম কুপের কাছে নিয়ে যান। এরপর বুক থেকে গলা পর্যন্ত চিঁড়ে বুক ও পেটের সমস্ত জিনিস এবং হৃৎপিণ্ড বের করে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেন। এরপর যখন খুব পরিষ্কার হয়ে যায় তখন ফেরেশতা জিব্রাইল একটা সোনার পেয়ালা নিয়ে আসেন। সে পেয়ালা থেকে জ্ঞান ও ঈমান ঢেলে বুক ও গলার শিরাগুলি পূর্ণ করে দেন। তারপর বুক শেলাই করে দেন। এরপর তিনি বুরাক নিয়ে আসেন। বুরাক ছিলো গাধার চেয়ে উঁচু আর খচ্চরের চেয়ে নিচু উজ্জ্বল সাদা বর্ণের একটি জন্তু। বুরাকের মুখ ছিলো নারীর মতো আর পাখা ছিলো ময়ুরের মতো। নবী বুরাকে উঠতে নিলে বুরাক ছটফট করতে থাকে। তখন জিব্রাইল বলেন, তুমি এটি কি করছো? তোমার উপরে উনার চেয়ে সম্মানিত কোন ব্যক্তি কোনদিন সওয়ার হয়নি। এরপর বুরাক শান্ত হয়। বুরাকের গতি এমন, তাঁর দৃষ্টি যতদুর পর্যন্ত যায় সেই দূরত্ব সে এক কদমে যায়।
তিনি বুরাকে গমন করা শুরু করলে প্রথমে রাস্তায় দেখেন দুজন লোক তাঁকে ডাকছেন। কিন্তু তিনি পাত্তা দিলেন না। এরপর কিছুদুর গিয়ে দেখেন রাস্তায় একজন নারী যাবতীয় কামোদ্দীপনা ও সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে নবীকে থামতে বললো। নবী ভ্রূক্ষেপও করলেন না,থামলেনও না। তারপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে দরজার সাথে শেকলে বুরাককে বেঁধে রেখে বাইতুল মুকাদ্দাসে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। এরপর জিব্রাইল এক পেয়ালায় দুধ আর আরেক পেয়ালায় মদ নিয়ে আসলেন। নবী দুধ পছন্দ করলেন। এরপর জিব্রাইল বললেন আপনি দুনিয়ার ফিতরাত (প্রকৃতি) বুঝে গেছেন।
এরপর জিব্রাইল দেখলেন নবী কিঞ্চিৎ চিন্তিত। তিনি তখন নবীকে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। নবী তখন সব ঘটনা খুলে বললেন। তখন জিব্রাইল বললেন, প্রথম লোকটি ছিলো ইহুদী, আপনি যদি তাঁর কথার উত্তর দিতেন তাহলে আপনার উম্মত সব ইহুদী হয়ে যেতো। দ্বিতীয় লোকটি ছিলো খ্রিস্টান, আপনি তাঁর কথার উত্তর দিলে আপনার উম্মত সব খ্রিস্টান হয়ে যেতো। আর নারীটি ছিলো দুনিয়া। আপনি যদি থামতেন তাহলে আপনার উম্মতেরা আখিরাতের চেয়ে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতো ও পথভ্রষ্ট হতো।
এরপর জিব্রাইল তাঁকে প্রথম আকাশের দরজাগুলির একটিতে নক করেন। পরিচয় দেয়ার পর দ্বাররক্ষী ফেরেশতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।এরপর প্রথম আকাশে গিয়ে দেখেন এক লোকের দুইপাশে অনেক লোক। লোকটি ডানদিকে তাকিয়ে হাসছেন ও বামদিকে তাকিয়ে কাঁদছেন। জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলে জিব্রাইল বলেন, ইনি হচ্ছেন বাবা আদম, আর দুইপাশের লোকজন তাঁর সন্তান। ডানদিকের লোকজন জান্নাতী, ও বামপাশের লোকজন জাহান্নামী। এরজন্য তিনি ডানে তাকিয়ে হাসছেন আর বামে তাকিয়ে কাঁদছেন। বাবা আদম নবীকে দেখে খুবই খুশি হন। তিনি বলেন আমার সন্তানদের মধ্যে তুমি সর্বোত্তম। এরপর নবী মুহাম্মদ সেখানে দুটি নহর দেখতে পান। জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলে জিব্রাইল উত্তর দেন এগুলো নীল ও ফোরাতের (ইউফ্রেটিস নদী) উৎস । এরপর তিনি একটি মণিমুক্তার প্রাসাদ ও সাথে আরো একটি নহর দেখতে পান। জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলে জিব্রাইল উত্তর দেন এটি হচ্ছে নহরে কায়সার।
এরপর দ্বিতীয় আকাশে ঈসা নবী ও ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করেন, তৃতীয় আকাশে ইউসুফ, চতুর্থ আকাশে নবী ইদ্রিস, পঞ্চম আকাশে নবী হারুন, ষষ্ঠ আকাশে নবী ইব্রাহিম ও সপ্তম আকাশে মুসা নবীর সাথে দেখা হয়। সেখানে তিনি ভাগ্য লেখনের কলমের খচ খচ আওয়াজ পান। এরপর মুসা নবীকে অতিক্রম করে সিদরাতুল মুনতাহা অর্থাৎ আকাশের শেষ সীমানার কুল গাছের কাছে পৌঁছান। যে সীমানা কোন ফেরেশতাও অতিক্রম করতে পারে না। অতপর তিনি আল্লাহর আরশের একদম নিকটে পৌঁছান। এরপর আল্লাহ নবীর উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন। এরপর সপ্তম আসমানে আসলে মুসা নবী বলেন এটি আপনার উম্মতের ক্ষমতার বাইরে, আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে কমানোর আবেদন করেন। এরপর বারবার যাওয়া আসা করে পঞ্চাশ ওয়াক্তের জায়গায় পাঁচ ওয়াক্ত নিয়ে আসেন। তখন আল্লাহ বলেন, কিন্তু কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তাহলে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াবই পাবে। এই তথ্য নিয়ে মুসা নবীর কাছে আসলে মুসা নবী আবারও যেতে বলেন। তখন আল্লাহর নবী বলেন এত সুবিধা দেওয়ার পর আমি আবার কোন মুখে যাই?
অনেক স্কলার অবশ্য এক্ষেত্রে বলেন, তিনি আল্লাহকে সরাসরি দেখেন নি। আল্লাহর নূর দেখেছেন।
নবী মুহাম্মদ এরপর বেহেশত ও দোযখ দুইই পরিদর্শন করেন।
বেহেশতে দেখলেন সুন্দর সুন্দর মণিমুক্তার প্রাসাদ, রঙ বেরঙ্গের ফুল, নেশাহীন মদের নহর, মধুর নহর, দুধের নহর, সুন্দর সুন্দর পাখি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এতো সুন্দর পাখি? জিব্রাইল উত্তর দিলেন যারা এটি খাবে তাঁরা আরোও উত্তম।
তিনি দেখলেন সাজানো গোছানো চমৎকার বাগান, সেখানে সোনার ফড়িং উড়ছে। বাগানের ডালিম ফলগুলো বড় বড় বালতির সমান। সুশীতল বাতাস, মনোরম পরিবেশ। ক্লান্তি দূর করা গাছের ছায়া। সেই গাছের ছায়া এত বড় যে একটি দ্রুতগামী ঘোড়া সত্তর বছরেও সেই পথ শেষ করতে পারে না। চারদিকে আল্লাহর নূরের আলোয় উদ্ভাসিত। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো রেশম, মণি-মুক্তা, সোনা-রুপা।
এরপর তিনি কাউসারের পানি পান করলেন। কাউসারের পানি দুধের চেয়েও সাদা, মধুর চেয়েও মিষ্টি, মিশকে অম্বরের চেয়েও সুগন্ধময়।
এরপর বেহেশতে একদল অপূর্ব সুন্দরী যুবতীদের দেখে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কারা?” হুরেরা উত্তর দেয়, আমরা হলাম চরিত্রবতী পরমাসুন্দরী হুর।আমরা আল্লাহর পরহেজগার ও নেককার বান্দাদের স্ত্রী, আমরা চিরকুমারী, কোন চোখ আমাদের দেখেনি, কোন কান আমাদের কন্ঠ শোনেনি, কোন হাত আমাদের স্পর্শ করেনি, আমরা কখনো বৃদ্ধ হবো না, আমাদের সৌন্দর্য কখনো কমবে না, আমাদের যৌবনে কখনো ভাটা পড়বে না।
এরপর নবী গেলেন দোযখ পরিদর্শনে। কিছু লোক দেখতে পান যাদের তামার নখ, নখ নিয়ে নিজেদের শরীরের মাংস খুবলে খুবলে তুলে ফেলছিলো। জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলে জিব্রাইল উত্তর দেন তাঁরা স্বজাতির মাংস ভক্ষণ করতো ( গিবত করতো), তাই তাঁদের এই অবস্থা।
আরো কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে তিনি একটা জায়গায় পৌঁছালেন যেখানে একপাশে অত্যন্ত উত্তম ভাজা গোশত আরেকদিকে পচা দুর্গন্ধময় ভাজা গোশত। তিনি দেখলেন একদল লোক ঐ উত্তম গোশত ছেড়ে পচা গোশত খাচ্ছে। জিব্রাইল তখন ব্যাখ্যা করলেন এরা আপনার উম্মতের মধ্যে সেসব লোক যারা হালাল ছেড়ে হারামের দিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, তারা সেইসব লোক যারা হালাল স্ত্রীদের ছেড়ে হারাম নারীদের সাথে ব্যভিচার করে।
এরপর দেখলেন ফেরেশতারা কিছু লোকের জিহবা ও ঠোঁট কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলছে ও আবার জোড়া লেগে যাচ্ছে। জিব্রাইল বললেন এরা সেই সমস্ত বক্তা ও উপদেষ্টা যারা তাঁদের বক্তৃতা দ্বারা মানুষকে কুপথে পরিচালিত করতো।
আরো কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন কিছু লোকের মুখ উটের মতো। ফেরেশতারা জোর করে পচা মাংস মুখ ফেড়ে ফেড়ে ভরে দিচ্ছেন ও সেই মাংস পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। জিব্রাইল বললেন এরা তারা , যারা এতিমদের টাকাপয়সা মেরে খেতো।
এরপর তিনি কিছু মহিলাকে দেখলেন যারা তাদের স্তনের উপরে ঝুলে আছে এবং হায় হায় করছে। নবী জিজ্ঞেস করলে জিব্রাইল উত্তর দেন , এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের মধ্যে ব্যভিচারিণী নারীসকল।
আর একদিকে কিছু লোক দেখলেন যাদের পেট বড় বড় ঘরের মতন। কিছু জন্তু তাঁদেরকে পিষে ফেলছে। আবার তারা তাদের আগের আকৃতি ফিরে পাচ্ছে। এরা হচ্ছে সুদখোর।
একদল লোককে দেখলেন যাদের মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে, আবার মাথা আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। জিব্রাইল বললেন এরা হচ্ছে তারা যাদের নামাজের সময় মাথা ভারী হয়ে যেতো।
আরেকদলকে দেখলেন যারা জাহান্নামের কাঁটাযুক্ত গাছ, পাথর ও অংগার খাচ্ছে। এরা সেইসব লোক যারা যাকাত প্রদান করতো না ও গরীবের হক আদায় করতো না।
সবকিছু পরিদর্শন শেষে তিনি ফিরে আসলে বায়তুল মুকাদ্দাসে সব নবীর সাথে তাঁর আবার দেখা হয়। সেখানে সবাই জামাতে নামাজ আদায় করেন। জিব্রাইল নবী মুহাম্মদকে ইমামতি করার জন্য ঠেলে দেন। এরপর বুরাকে করে তিনি উম্মে হানির ঘরে ফিরে আসেন। তিনি ফিরে এসে দেখেন তাঁর ওজুর পানি তখনো গড়িয়ে পড়ছে (২০০)।
ইবনে সা’দের বর্ণনায় পাওয়া যায়, ঐ রাত্রে নবী মুহাম্মদ নিখোঁজ হয়ে যান। তাই আবদুল মুত্তালিবের পরিবারের সদস্যরা নবীর খোঁজে বাহির হন। কাবার আশেপাশে গিয়ে আল আব্বাস মুহাম্মদ মুহাম্মদ করে চিৎকার করতে থাকেন। তখন একসময় নবীর কাছে থেকে জবাব আসে যে আমি এখানে। আল আব্বাস তখন বলেন,” ভাতিজা, তুমি তো আমাদের খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। তুমি ছিলে কোথায় এতো রাতে?” নবী উত্তর দেন, “আমি বায়তুল মোকাদ্দিস থেকে আসছি।“ আল আব্বাস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”এই এক রাতেই?” নবী উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। (২০১)।
যখন তিনি সবাইকে মিরাজের কথা বললেন, তখন সবাই তাঁকে পাগল সাব্যস্ত করলো। বহু লোক ইসলাম ত্যাগ করলো। তারা বললো এসব ঘটনা শোনার পর আমরা তাঁকে আর সত্যবাদী মনে করি না। কুরাইশ প্যাগানরা হাসাহাসি করলো। তখন তিনি প্রমাণস্বরূপ বাইতুল মুকাদ্দাসে কয়টা দরজা, পথে কোন কোন কুরাইশ কাফেলা দেখেছেন, কোন কাফেলার উটের পা ভেংগেছে এসব বললেন। মুশরিকরা আবু বকরকে গিয়ে এই খবর বললে আবু বকর বলে উনি যদি বলে থাকেন তাহলে ঘটনা সত্য। এরচেয়েও বড় অলৌকিক কিছু ঘটে থাকলেও আমি বিশ্বাস করবো। সেই থেকে আবু বকরের নাম হয় সিদ্দিক (২০০)।
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের করা ইবনে হিশামের অনুবাদ থেকে সরাসরি তুলে দিচ্ছি,
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বের হয়ে গিয়ে লোকদের এ ঘটনা জানালেন। তারা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘হে মুহাম্মাদ! এ যে সত্য তার প্রমাণ? এমন ঘটনা তো আমরা কোনোদিন শুনিনি।’ তিনি বললেন, ‘প্রমাণ এই যে, আমি অমুক উপত্যকায় অমুক গোত্রের একটি কাফেলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সহসা আমার বাহন জন্তুটির গর্জনে তারা ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের একটি উট হারিয়ে যায়। আমি তাদের উটটির সন্ধান দিই। আমি তখন শামের দিকে যাচ্ছিলাম। এরপর সেখান থেকে ফিরে আসার পথে যখন দাজনান পর্বতের কাছে পৌঁছি, তখন সেখানেও একটি কাফেলা দেখতে পাই। তারা সকলে নিদ্রিত ছিল। তাদের কাছে একটি পানিভরা পাত্র ছিল, যা কোনো কিছু দিয়ে ঢাকা ছিল। আমি সে ঢাকনা সরিয়ে তা থেকে পানি পান করি। এরপর তা আগের মতো করে ঢেকে রেখে দিই। আর এর প্রমাণ এই যে—সে কাফেলাটি এখন বায়যা গিরিপথ থেকে ‘সানিয়াতুত তানঈমে’ নেমে আসছে। তাদের সামনে একটি ধূসর বর্ণের উট আছে, যার দেহে একটি কালো ও আরেকটি বিচিত্র বর্ণের ছাপ আছে।’”
উম্মে হানী(রা.) বলেন, “একথা শোনামাত্র উপস্থিত লোকেরা সানিয়ার দিকে ছুটে গেলো। তারা ঠিকই সম্মুখভাগের উটটিকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর বর্ণনামতো পেলো। তারা কাফেলার কাছে তাদের পানির পাত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তারা বললো, ‘আমরা পানির একটি ভরা পাত্রে ঢাকনা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। জাগ্রত হওয়ার পর পাত্রটিকে যেমন রেখেছিলাম তেমনই ঢাকা পাই, কিন্তু ভেতর পানিশূন্য ছিল।’ তারা অপর কাফেলাকেও জিজ্ঞেস করলো। সে কাফেলাটি তখন মক্কাতেই ছিল। তারা বললো, ‘আল্লাহর কসম! তিনি সত্যই বলেছেন। তিনি যে উপত্যকার কথা বলেছেন, সেখানে ঠিকই আমরা ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমাদের একটি উট হারিয়ে যায়। আমরা অদৃশ্য এক ব্যক্তির আওয়াজ শুনতে পাই,যে আমাদের উটটির সন্ধান দিচ্ছিলো। সেমতে আমরা উটটি ধরে ফেলি (২০২)।”
এখানে আমার ব্যক্তিগত কিছু ডাউট আছে, ডাউটগুলো একান্তই আমার নিজের। গুগুল ম্যাপে দেখলাম দাজনান পর্বত থেকে মক্কার দূরত্ব ৭৯.৪ মাইল, পায়ে হেঁটে যেতে লাগবে ২৮ ঘন্টা (২০৩)। আর আরবের পণ্যবাহী উটগুলো সারাদিনে যেতে পারে ৪০ মাইল, বর্তমানে মিলিটারী ও রেসিংয়ে ব্যবহার করা হয় স্পেশাল ব্রিড, যারা যেতে পারে দিনে ৮০ থেকে ১২০ মাইল (২০৪) । এশার পর থেকে ভোর এইটুকু সময়ের মধ্যে কাফেলাটি দাজনান পর্বত থেকে মক্কায় চলে এলো সেটি মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এখানে মসজিদুল আকসা নিয়ে একটি কথা না বললেই নয়। মসজিদুল আকসা শব্দের অর্থ সবচেয়ে দূরবর্তী মসজিদ(Furthest mosque)। নবী ঐসময় মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুয়াদ্দাসের হুবহু বর্ণনা দিয়ে থাকেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে ওইসময় জেরুজালেমে মসজিদুল আকসার অস্তিত্ব ছিলো না। যা ছিলো সেটি ছিলো সলোমনের মন্দির বা সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসাবশেষ যা ৭০ সালেই রোমানদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। খলিফা উমরের শাসনামলে উমর যখন জেরুজালেম দখল করেন তখন সেখানে একটি ছোট একটি নামাজের ঘর নির্মাণ করেন। এরপরে ৭০৫ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল্লাহ আল মালিক এবং আল ওয়ালিদ সেখানে মসজিদুল আকসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসগত কারণেই এখন সেই জায়গাটা মুসলিম, খ্রীস্টান ও ইহুদীদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র।
আরেকটি বেশ কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে জুরুস্ট্রীয়ান ধর্মগ্রন্থ আরদা ভিরাগ নামাগ (বুক অফ আরদা ভিরাফ) গ্রন্থে এই ভ্রমণের বর্ণনা। বুরাক, দুধ ও মদের পেয়ালা, অন্য নবীদের সাথে সাক্ষাৎ, নামাজের আদেশ, বেহেশত-দোযখ ভ্রমণ সবই আছে। পার্থক্য একটাই, আরদা ভিরাফের ভ্রমণের বর্ণনা দেয়া আছে অনেক বিস্তারিতভাবে। লিংক দিয়ে দিলাম, বিশেষ করে দোযখের শাস্তির বর্ণনাগুলো পড়ে খুব মজা পাবেন। আগ্রহী পাঠকগণ বইটি পড়ে দেখতে পারেন (২০৫)।
মুসলিম স্কলাররা এই কাকতালীয় ঘটনার দুটি ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। একঃ আরদা ভিরাফ বলতে নবীকেই বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ মিরাজেরই ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। দুইঃ দশম ও একাদশ শতকের দিকে জালিয়াতির মাধ্যমে জুরুস্ট্রিয়ানদের ধর্মগ্রন্থে ঢুকানো হয়েছে। অবশ্য ইসলামের সমালোচনাকারীরা বলে থাকেন যে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের বুদ্ধিদাতা সালমান ফারসীর মুখেই নবী ঘটনাটি শুনেছেন।
এখন আসি পুরো সিরিজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে। যদিও এই বিষয়ের কথা ইশাক, তাবারী, সা’দ, কাছির, ওয়াকিদি কারো লেখায়ই পাইনি। কিন্তু অমুসলিম গবেষকদের ভাষ্যমতে, বহু লোকের ইসলাম ত্যাগ করার প্রধান কারণ মিরাজের অবিশ্বাস্য গল্প নয়, তাঁদের ধারণা ছিলো তিনি উম্মে হানীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে সূরা নাজমের প্রথম ১৮টি আয়াত নাজিল হয় এবং এতে প্রমাণিত হয় নবী নির্দোষ। প্রায় সবার লেখায়ই উম্মে হানীর ঘরে রাত্রিযাপনের কথা লেখা থাকলেও, ঠিক কি কারণে তিনি সেই রাতে উম্মে হানীর ঘরে ছিলেন এবং রাত্রিযাপনের কথা জানার পর সাহাবীদের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো সেটি কেউই উল্লেখ করেন নি। চলুন সেই আয়াতগুলো দেখে নিই,
১।নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়।
২। তোমাদের সংগী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি।
৩। এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না।
৪। কোরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়।
৫। তাঁকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা,
৬। সহজাত শক্তিসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল।
৭। উর্ধ্ব দিগন্তে,
৯। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরও কম।
১০। তখন আল্লাহ তাঁর দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবার, তা প্রত্যাদেশ করলেন।
১১। রসূলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে।
১২। তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে?
১৩। নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল,
১৪। সিদরাতুলমুন্তাহার নিকটে,
১৫। যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত।
১৬। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল।
১৭। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয় নি এবং সীমালংঘনও করেনি।
১৮।নিশ্চয় সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছে (২০৬)।
ইসলামিক তাফসীরগুলিতে যে শানে নজুল পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে,
বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ও নাসায়ীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ————–(সর্ব প্রথম যে সূরাটিতে সিজাদার আয়াত নাযিল হয়েছে, সেটি হচ্ছে আন -নাজম) । এ হাদীসের যে অংশসমূহ আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ, আবু ইসহাক এবং যুহারের ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক ইবনে মাসউদের রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, এটি কুরআন মজীদের প্রথম সূরা যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের এক সমাবেশে (ইবনে মারদুইয়ার বর্ণনা অনুসারে হারাম শরীফের মধ্যে ) শুনিয়েছিলেন। সমাবেশে কাফের ও ঈমানদার সব শ্রেনীর লোক উপস্থিত ছিল। অবশেষে তিনি সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করলে উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে সিজদা করে। এমনকি মুশরিকদের বড় বড় নেতা যারা তাঁর বিরোধিতার অগ্রভাবে ছিল তারাও সিজদা না করে থাকতে পারেনি। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন; আমি কাফেরদের মধ্যে মাত্র এক ব্যক্তি অর্থাৎ উমাইয়া ইবনে খালফকে দেখলাম, সে সিজদা করার পরিবর্তে কিছু মাটি উঠিয়ে কপালে লাগিয়ে বললোঃ আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে আমি নিজ চোখে তাকে কাফের অবস্থায় নিহিত হতে দেখেছি এ ঘটনার অপর একজন চাক্ষুষদর্শী হলেন হযরত মুত্তালিব ইবনে আবী ওয়াদা’আ । তিনি তখনও মুসলমান হননি। নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদে তাঁর নিজের বক্তব্য এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী (সা) সূরা নাজম পড়ে সিজদা করলেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে সিজদা করলো। কিন্তু আমি সিজদা করিনি। বর্তমানে আমি তার ক্ষতিপূরণ করি এভাবে যে, এ সূরা তিলাওয়াতকালে কখনো সিজদা না করে ছাড়ি না।
ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন, ইতিপূর্বে নবুওয়াতের ৫ম বছরের রজব মাসে সাহাবা কিরামের একটি ছোট্ট দল হাবশায় হিজরত করেছিলেন। পরে ঐ বছর রমযান মাসেই এ ঘটনা ঘটে অর্থাৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের জনসমাবেশে সূরা নাজম পাঠ করে শোনান এবং এতে কাফের ও ঈমানদার সবাই তাঁর সাথে সিজদায় পড়ে যায়। হাবশায় মুহাজিরদের কাছে এ কাহিনী এভাবে পৌছে যে, মক্কায় কাফেররা মুসলমান হয়ে গিয়েছে। এ খবর শুনে তাদের মধ্যেকার কিছু লোক নবুওয়াতের ৫ম বছরের শাওয়াল মাসে মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু এখানে আসার পরে জানতে পারেন যে, জুলুম-নির্যাতন আগের মতই চলেছে। অবশেষে হাবশায় দ্বিতীয়বার হিজরত করার ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে প্রথমবারের হিজরতের তুলনায় অনেক বেশী লোক মক্কা ছেড়ে চলে যায়।
এভাবে প্রায় নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, সূরাটি নবুওয়াতের ৫ম বছরের রমযান মাসে নাযিল হয়েছিলো (২০৭)।
প্রায় সব প্রসিদ্ধ তাফসীর অনুসারে এটা জানা যায় যে সূরা নাজমের নাজিলকাল নবুয়তের পঞ্চম বছরে, অর্থাৎ ৬১৫ সালে। কিন্তু তাহলে ১২-১৮ তম আয়াতে মিরাজের কথা কি করে এলো সেটা ভাববার বিষয়।
নবীর মৃত্যুর তিন বছর আগ পর্যন্তও উম্মে হানী ইসলাম গ্রহণ করেননি। কিন্তু এরপরেও তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিলো এবং তিনি প্রায়ই ফাখিহাহর বাড়িতে যাতায়াত করতেন এর ইংগিত পাওয়া যায় সিরাত ও বিভিন্ন হাদীসে।
আবূ তালিবের কন্যা উম্মু হানী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার ঘরে এসে বললেনঃ তোমাদের (খাওয়ার মতো) কিছু আছে কি? আমি বললাম, কয়টি শুকনা রুটির টুকরা এবং সিরকা ব্যতীত আর কিছু নেই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ (আমাকে) তা-ই দাও। যে ঘরে সিরকা রয়েছে সে ঘর তরকারিশূন্য নয় (২০৮)।
ওয়াকিদির বর্ণনায় পাওয়া যায়, খায়বারের যুদ্ধলব্ধ খাদ্যদ্রব্য ভাগ করার সময় তিনি প্রত্যেক স্ত্রীকে দিয়েছেন আশি ওয়াসাক খেজুর ও বিশ ওয়াসাক যব, অথচ ত্রিশ ওয়াসাক যব দিয়েছেন উম্মে হানীকে। ( তিনশো কেজির বেশি) (২০৯)। উম্মে হানী বলতেন, “আমি আল্লাহর রসুলের চাইতে সুন্দর হাসি আর কারও মুখে দেখি নাই। আর আমি যখনই আল্লাহর রসূলের পেট দেখতাম তখনই আমার মনে পড়ে যেত। [এই খানে কিতাব আল মাগহাযির ইংরেজি অনুবাদক ব্র্যাকেটে লিখেছেন: উম্মে হানী এখানে নবীর ত্বকের ভাঁজের কথা বলছেন—অর্থাৎ নগ্ন পেটের] আমি মক্কা বিজয়ের দিনে উনার মাথায় চারটি বেণী বাঁধা দেখেছি (২১০) ।
উম্মে হানীর অনুরোধে তিনি শত্রুকেও মাফ করে দিয়েছেন। এপ্রসঙ্গে ইবনে ইশাকের সিরাতে উম্মে হানীর জবানিতে একটি বিবরণ পাওয়া যায়,
“যখন নবী মুহাম্মদ মক্কার উপরের অংশ অবরোধ করে রাখেন তখন বনু-মাখজুম গোত্রের আমার দুই শ্যালক আমার কাছে পালিয়ে আসে। আমার ভাই আলি তখন প্রতিজ্ঞা করেন যে এঁদেরকে হত্যা করবেন। আমি তাঁদের বাচানোর জন্য দরজা আটকে নবীর কাছে আসি। আমি যখন নবীর ঘরে যাই তখন দেখি তিনি বড় একটা গামলায় লেগে থাকা ময়দা পরিষ্কার করছেন। ময়দা পরিষ্কার করা শেষ হলে তিনি আট রাকাত নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? আমি তখন সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, “তুমি যাদেরকেই নিরাপত্তা দাও, আমরাও তাঁদেরকে নিরাপত্তা দিই। তুমি যাদেরকে আশ্রয় দাও, আমরা তাঁদেরকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিবো। আলি কোনভাবেই তাঁদেরকে হত্যা করতে পারবে না (২১১)।“
মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণনাটি কিঞ্চিৎ অন্যরকম,
উম্মু হানী (রাঃ)-এর আযাদকৃত দাস আবূ মুর্‌রাহ্‌ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, তিনি আবূ ত্বলিবের কন্যা উম্মু হানী (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন। (তিনি বলেছেন) মক্কা বিজয়ের বছরে আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি গোসল করছেন আর তাঁর কন্যা ফাত্বিমাহ্‌ একটি কাপড় দিয়ে তাঁকে পর্দা করে রেখেছেন। উম্মু হানী বলেন- আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তখন তিনি জানতে চাইলেন, কে? আমি বললামঃ আমি আবূ ত্বলিবের কন্যা উম্মু হানী। তিনি (খুশীতে) বললেনঃ উম্মু হানীকে স্বাগতম। অতঃপর গোসল শেষ করে তিনি সলাতে দাড়াঁলেন এবং একটি মাত্র কাপড় গায়ে জড়িয়ে আট রাক‘আত সলাত আদায় করলেন। সলাত শেষে আমি তাঁকে বললামঃ হে আল্লাহর রসুল! আমার ভাই ‘আলী ইবনু আবু ত্বলিব বলেছেনঃ তিনি আবু হুরায়রাহ্‌ (রাঃ)-এর পুত্র অমুককে হত্যা করে ছাড়বেন অথচ আমি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। সব শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে উম্মু হানী! তুমি যাকে নিরাপত্তা দান করেছ আমিও তাকে নিরাপত্তা দান করেছি। উম্মু হানী বর্ণনা করেছেনঃ এ ঘটনা ছিল ‘যুহা’ বা চাশ্‌তের সময়ের। (২১২)
উম্মে হানীর সাথে যে নবীকে বেশ মান্য করতেন সেটি নীচের হাদীসে প্রকাশ পায়।
উম্মু হানী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে আমি বসা ছিলাম। তাঁর কাছে কিছু শরবত নিয়ে আসা হল। তা হতে তিনি পান করলেন, তারপর আমাকে তা দিলেন। আমিও তা হতে কিছু পান করলাম। আমি বললাম, আমি তো অপরাধ করে ফেলেছি। আপনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি বললেনঃ তা কিভাবে? আমি বললাম, আমি রোযা রেখেছিলাম, তা ভেঙ্গে ফেলেছি। তিনি বললেনঃ তুমি কোন রোযার কাযা আদায় করছিলে কি? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাহলে এতে তোমার কোন ক্ষতি নেই (২১৩)।
মক্কা বিজয়ের সময় হুবায়রা ইসলাম গ্রহণ না করে নাজরানের দুর্গে পালিয়ে যান। অপরদিকে উম্মে হানী হুবায়রার সাথে পালিয়ে না গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। উম্মে হানীর ইসলাম গ্রহণ করার সংবাদ পেয়ে হুবায়রা অনেকগুলি কবিতা লিখেন, তাঁর একটির অনুবাদ (যিনি অনুবাদ করতে আমাকে সাহায্য করেছেন তাঁকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ!!),
তোমার নামে ওঠে কি ঝড় হিন্দ-হৃদয়ে আজও?
তার স্মৃতিতে মধুর সুরে বাদ্য হয়ে বাজো?
পাল্টে দিলি সব কিছু তুই হায় রে ব্যবধান,
কেড়েই নিলি নিদ্রা মম দুর্গে নাজরান।
রাত্রি নামে, দুচোখ দিয়ে তবুও দেখি তারে,
ছায়ার মত চিত্তে দোলা দেয় সে বারে বারে।
তাও সে বলে দোষটা আমার, আমারই সব ভুল,
শপথ রাতের, দেবেই জেনো একদিন মাশুল-
মানি যদি পরিবারের হুকুম, আমি শেষ-
বলেছিল সে, ঠোঁটে ছিল নিঠুরতম শ্লেষ।
হায় রে তবু, অবুঝ হৃদয়, মানে না, সে নেই-
ধ্বংস আমার হারিয়ে তাকে, ব্যাথার সমুদ্রেই।
কিন্তু আমার গোত্র জেনো বীরভোগ্য ধরায়
সেই বীরদের বর্ম আমি, আমাকে কে হারায়?
যখন তারা চালায় অসি, যেন ছেলে খেলা-
বর্শা মুখে, বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সারা বেলা।
বর্ম হয়ে প্রদান করি, তাদের নিরাপত্তা,
তাদের তরে বিলিয়ে দেব আমার আপন সত্তা।
হিংসা যারা করে মোদের, করি চরম ঘৃণা,
রিজিক দেবেন খোদাই মোদের, বাজুক বিষের বীণা।
মুহম্মদের ধর্ম মিছে, মাথা ছাড়া তীর,
শিষ্য হলে হারবে জেনো, হওনা যতই বীর।
আত্মীয়তার শেকল যদি পরো পায়ে তুমি,
থাকো তবে দূরেই আমার, পাহাড় বৃত্তভূমি-
যেয়ো সেথায়, ছেড়ে আমায়, হেথায় বেঁধো নীড়,
শুষ্ক ধূলাই পাবে, ভোরের রইবে না শিশির (২১৪)।
উম্মে হানী ইসলাম গ্রহণ করলে নবী মুহাম্মদ উম্মে হানিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, কিন্তু উম্মে হানি রাজি হন না। তিনি কারণ দেখান যেহেতু তাঁর ছোট বাচ্চা আছে, সেহেতু বিয়ে করলে স্বামীর প্রতি সুবিচার করতে পারবেন না। (২১৫)
তিনি বলেন, “আল্লাহর শপথ, আমি জাহিলিয়াতের যুগে আপনাকে ভালোবাসতাম, এখনো বাসি, আমার ছোট ছোট বাচ্চা আছে, আমার ভয় হয় তাদের কারণে আপনার অসুবিধা হবে।“ নবী উত্তরে বলেন, “আল্লাহর কসম, উটের পিঠে চড়েছে এমন নারীদের মধ্যে সেরা হচ্ছে কুরাইশের নারীরা। তাঁরা শিশুদের প্রতি সবচেয়ে মমতাময়ী এবং সম্পদ দেখাশোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে আদর্শ স্ত্রী। (২১৬)।
এর কিছুদিন পর ফাখিতাহ নিজেই যান নবীর কাছে, গিয়ে বলেন, এখন আমার বাচ্চা-কাচ্চারা একটু বড় হয়েছে, এখন চাইলে আমরা বিয়ে করতে পারি। নবী বললেন, বেশি দেরি হয়ে গেছে, সূরা আহজাবের ৫০ নম্বর আয়াত দেখিয়ে বললেন, ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে যারা মদিনায় হিজরত করেনি, তাঁদেরকে বিয়ে করা আমার জন্য নিষিদ্ধ (২১৭)। আয়াতটি হচ্ছে,
“হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু(২১৮)।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। নবী মক্কা জয় করেন ৬৩০ সালে আর মারা যান ৬৩৩ সালে। ঠিক কোন সময় ফাখিহাহর বাচ্চারা বড় হলো এবং কোন সময় ফাখিহাহ প্রস্তাব দিলেন সেই সঠিক তথ্য আমি জানি না।
নবীর মৃত্যু পরবর্তী উম্মে হানীর জীবন নিয়ে প্রায় কিছুই জানা যায় না। তিনি কখন, কোথায় ও কিভাবে মারা গেলেন সেই তথ্যও অজানা।
নবী মুহাম্মদের সংস্পর্শে আসা নারী ও উম্মুল মুমেনীনদের গল্প এখানেই সমাপ্তি। পুরো সিরিজ, বিশেষ করে আজকের পর্বটি লিখতে কতো সময় লেগেছে একমাত্র আল্লাহপাকই জানেন। তাই বিদায় হজ্জের ভাষনের মতো আকাশে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, হে আল্লাহ, উম্মুল মুমেনীনদের অজানা গল্প আমি কি সবার নিকটে পৌঁছে দিতে পেরেছি? উত্তরের অপেক্ষায় থেকে এখানেই ঘটনাবহুল ইতিহাসের পরিসমাপ্তি এবং আমার বিদায়!
তথ্যসুত্রঃ
(১৯৮) ইবনে সাদ (উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১০৯।
(১৯৯) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ১৮৪।
(২০০) তাফসীরে ইবনে কাসির, সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত ১।
(২০১) ইবনে সাদ, প্রথম খন্ড( দ্য মেন অফ মদিনা) পৃষ্ঠা ২৪৮।
(২০২) সীরাতুন নবী (সা.) - ইবন হিশাম, ২য় খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃষ্ঠা : ৭৬-৭৭।
(২০৩)
(২০৬) সূরা আন-নাজম আয়াত ১-১৮।
(২০৭) তাহফীনুল কুরআন, সূরা নাজম এর শানে নযুল।
(২০৮) তিরমিজি, হাদীস নং ১৮৪১।
(২০৯) আল ওয়াকিদি, কিতাব আল মাগাজি, পৃষ্ঠা ৩৪২।
(২১০) আল ওয়াকিদি, কিতাব আল মাগাজি, পৃষ্ঠা ৪২৭।
(২১১) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৫৫১-৫২।
(২১২) সহীহ মুসলিম ১৫৩৪ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৫৩৯)।
(২১৩) তিরমিজি ৭৩২, আবু দাউদ ২১২০।
(২১৪) ইবনে ইশাক (লাইফ অফ মুহাম্মদ), পৃষ্ঠা ৫৫৭।
(২১৫) তাবারী, নবম খন্ড (দ্য লাস্ট ইয়ারস অফ দ্য প্রফেট), পৃষ্ঠা ১৪০।
(২১৬) তাবারী, ৩৯তম খন্ড (বায়োগ্রাফি অফ প্রফেটস কম্পানিয়ন্স এন্ড দেয়ার সাকসেসরস),পৃষ্ঠা ১৯৬-৯৭, সহীহ মুসলিম ৬৩৫৩ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৬৯)
(২১৭) ইবনে সাদ (উইমেন ইন মদিনা), পৃষ্ঠা ১১০।
(২১৮) সূরা আহজাব, আয়াত ৫০।
( ছবিটি ষোড়শ শতাব্দীর পার্সিয়ান চিত্রশিল্পী সুলতান মাহমুদের আঁকা) বিঃদ্রঃ সম্পূর্ন লেখাটি লিখেছিলেন প্রিয় ভাই মঞ্জুরুল ইসলাম রিফাত ভাই আমাদের প্রিয় এন্টারকটিক ফেসবুক গ্রুপে । লেখাটির সমস্ত কৃতিত্ব রিফাত ভাইয়ের ।

No comments

Powered by Blogger.