হজ্জ্বের মাধ্যমে সৌদি আরব বছরে কতটাকা কামায়?
হজ্জ্বের মাধ্যমে সৌদি আরব বছরে কতটাকা কামায়?

হজ এখন সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় ব্যবসার নাম!!!
সৌদি আরবের প্রধান ব্যবসা কি, এটা যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি নির্ঘাত তেলের কথাই বলবেন। মধ্যপ্রাচ্য যে তেলের ভাণ্ডার, আর সৌদি আরবের সমৃদ্ধির পেছনেও যে এই তেলের একটা বড় অবদান আছে, সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্ত তেলের মজুদ ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, আগামী দশ-পনেরো বছর পরে হয়তো আর তেল বিক্রি করার মতো অবস্থায় সৌদি আরব থাকবে না।
সেকারণেই দেশটার সরকার এখন সৌদি আরবকে বিদেশী ট্যুরিস্টদের কাছে সহজলভ্য এবং আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করছে। সিনেমা হল নির্মাণ করা হচ্ছে, বিকিনি বিচ বানানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে, যেটা হয়তো পাঁচ বছর আগেও কেউ কল্পনা করতে পারতো না। ট্যুরিজম কোনদিন সৌদি আরবের এক নম্বর ব্যবসা হতে পারবে কিনা, সেটা সময় বলে দেবে। কিন্ত আরও একটা ব্যবসা আছে, যেটার ওপর ভর করে সৌদি আরবের বর্তমান ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে। সেই ব্যবসাটার নাম সৌদি সরকার কখনও উচ্চারণ করে না, অনেকটা নাম বললে চাকরী থাকবে না অবস্থা। কিন্ত সত্যিটা হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরবের জাতীয় আয় সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে হজ ব্যবসার ওপরে। এটা আমি বলছি না, বলছে বিবিসি, রয়টার্স, আরব নিউজ বা দ্য গার্ডিয়ানের মতো প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যমগুলো!
ইসলামের প্রধান পাঁচটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে হজ। প্রত্যেক সামর্থ্যবান সুস্থ মুসলিমের ওপর জীবনে অন্তত রজবার হজব্রত পালন করা ফরজ, ইসলাম ধর্মে বলা আছে এমনটাই। জ্ঞান অর্জনের জন্যে সুদূর চীনদেশে যেতে বলেছিলেন নবী মুহাম্মদে, আর হজ পালনের জন্যে যেতে হয় নবীজির দেশে, সৌদি আরবে। প্রতিবছর হজের মৌসুমে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান সৌদি আরবে পাড়ি জমান হজ পালন করে খোদার সন্তুষ্টি লাভের আশায়। হজ করতে আসা মানুষের সংখ্যাটা গড়ে পঁচিশ থেকে ত্রিশ লক্ষের মধ্যে থাকে প্রতিবছর, কখনও এরচেয়ে বেশিও হয়। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে হজ আর উমরাহ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৩ লক্ষ! বাংলাদেশ থেকেই প্রতিবছর সরকারী ও বেসরকারীভাবে কয়েক লক্ষ মানুষ হজ করতে সৌদি আরবে পাড়ি জমান।
হজ বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে করা গেলেও, সারা বছর ধরেই উমরাহ করতে যাওয়া যায়। যেমন গত বছরই প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ উমরাহ করতে গিয়েছিলেন সৌদিতে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে যারা সৌদি আরবে গেছেন, তাঁদের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই উমরাহ করতে গিয়েছিলেন। সাত বছর আগে উমরাহ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। এখন বছরে ৬০-৭০ লক্ষ মানুষ উমরাহ করছেন, আর সৌদি আরবের হিসাব অনুযায়ী আগামী চার বছরের মধ্যে এই সংখ্যাটাই বেড়ে এক কোটি ২০ লক্ষ হয়ে যাবে!
হজযাত্রীদের জন্যে সৌদি সরকার নির্ধারিত একটা কোটা ঠিক করে দেয়। যেমন মোট হজযাত্রীদের আট শতাংশ বাংলাদেশ থেকে যাবেন। ইন্দোনেশিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমানের দেশ, হজযাত্রীদের শতকরা চৌদ্দ শতাংশ সেখান থেকে যান। ভারত এবং পাকিস্তান থেকে যান এগারো শতাংশ করে। এরকম বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশের জন্যেই কোটা সিস্টেম করে দেয়া আছে, চাইলেও কোন দেশ থেকে এই সংখ্যার বেশি হজযাত্রী যেতে পারবেন না।
এবার চলুন, ব্যবসাটা কোথায় হয় সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ হজে যান বৃদ্ধ বয়সে। চাকরী শেষ করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, সংসারের দায়িত্ব পালন করে তারপর খোদার ডাকে সাড়া দিতে ছোটেন তারা। কেউ কেউ সারা জীবনের আয় থেকে অল্প-স্বল্প করে জমিয়ে রাখেন হজে যাবেন বলে, কেউবা জায়গা-জমি বিক্রি করে যাত্রা করেন মক্কার উদ্দেশ্যে। অথচ এই নীরিহ ধর্মপ্রাণ(সবাই নন) মানুষগুলো জানতেও পারেন না, কত ধাপে কত জনের কাছে ব্যবসার পণ্য হতে যাচ্ছেন তারা!
হজের ব্যবসাটা মূলত দুই ধাপে হয়। ধরুন আপনি বাংলাদেশী হজযাত্রী। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক যোগাযোগ না থাকলে সরকারীভাবে হজে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম আপনার। যেতে হবে বেসরকারীভাবে, কোন ট্রাভেল এজেন্সি বা হজ কাফেলার সঙ্গে। গলা কাটার শুরু এখান থেকেই। তবে এই অংশটার কথা অন্য একদিন বলবো, কারন এখানে বলার মতো অনেক কিছুই আছে। লিখতে গেলে রাত শেষ হয়ে যাবে আজ শুধু হজকে কিভাবে সৌদি আরব ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছে, সেটা নিয়েই লিখবো।
বাংলাদেশ থেকে যদি এক লক্ষ হজযাত্রী হজে যাওয়ার অনুমতি পান, তাহলে সেসব যাত্রীদের মধ্যে অর্ধেককে যেতে হবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে! এটাই নাকি নিয়ম! বাকি অর্ধেক যাত্রী বহন করবে বাংলাদেশ বিমান। মানে পাঁচ লক্ষ হজযাত্রী যদি হজ পালনের জন্যে সৌদি আরব যান, সেক্ষেত্রে আড়াই লক্ষ যাত্রীকে যেতে হবে সৌদি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে! তাদের ফ্লাইট তুলনামূল কম থাকুক, তাদের সার্ভিস খারাপ হোক বা অন্য কিছু হলেও যেতে হবে তাদের বিমানে চড়েই!
মক্কার চেম্বার অব কমার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাইরের দেশ থেকে হজের জন্যে সৌদিতে আসা মুসলমানরা মাথাপিছু ব্যয় করেন ৪৬০০-৫০০০ ডলার। তবে একেক দেশ থেকে আসা হজযাত্রীদের জন্য আবার একেক রকম খরচ। যেমন ইরান থেকে আসা মানুষদের মাথাপিছু প্রায় ৩৫০০ ডলার খরচ হয়। এর মধ্যে যাত্রা, খাওয়া, কেনাকাটা সব খরচই ধরা হয়। বাংলাদেশের যাত্রীদেরও মোটামুটি একইরকম খরচ হয়, তবে ট্রাভেল এজেন্সি বা হজ কাফেলাগুলো হজ যাত্রীদের কাছ থেকে এরচেয়ে অনেক বেশি টাকা নিয়ে থাকে।
এই হজযাত্রীরা মাসব্যাপী সৌদি আরবে হোটেল থাকছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন, হজের রীতিনীতি পালনের জন্যে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাচ্ছেন, পশু কুরবানী দিচ্ছেন, ব্যক্তিগত কেনাকাটাও করছেন। বাংলাদেশী হজযাত্রীরা সাধারণ হোটেলেই থাকেন, তবে মক্কা এবং মদীনায় এমনও হোটেল আছে, যেগুলোর একটি কক্ষে একরাত কাটাতে গেলেও গুণতে হয় প্রায় পাঁচ হাজার ডলার, যেটা বাংলাদেশী একজন হজযাত্রীর পুরো হজযাত্রার খরচ! তিউনিসিয়া, মরক্কো বা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা হজযাত্রীরা এসব হোটেলে থাকেন। পাশাপাশি যাওয়া আসার বিমানভাড়া তো আছেই। আর এই টাকাটা সরাসরি যুক্ত হচ্ছে সৌদি আরবের অর্থনীতিতে। গত বছর শুধু হজ থেকে সৌদি আরবের আয় ছিল পনেরো বিলিয়ন ডলারেরও বেশি!
আরব নিউজের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১২ সালে হজ ও উমরাহ মিলিয়ে সৌদি আরবের অন্তত এক হাজার ৬৫০ কোটি ডলার আয় হয়েছিল। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত আয় আরও অনেক বেশি। সৌদি আরবের জিডিপির শতকরা প্রায় সাত শতাংশ আসে হজ ব্যবসা থেকে! মক্কা-মদীনা-জেদ্দা বা তায়েফের মতো শহরগুলোর অর্থনীতি পরিচালিত হয় হজকে কেন্দ্র করে। হজের মৌসুমে শুধু জেদ্দায় বাদশাহ আবদুল আজিজ বিমানবন্দরে যে পরিমাণ বিমান ওঠা-নামা করে, তা পুরো বিশ্বের অন্য কোনো বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে হয় না। এই বিমানবন্দরের পরিসরও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে যেন ২০৩৫ সাল নাগাদ এখানে বছরে আট কোটি যাত্রী ওঠা-নামা করতে পারে।।
এত বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা, এত এত প্রাপ্তির পরেও হজের ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার ব্যাপারে খুব বেশি তৎপর হতে দেখা যায়নি সৌদি কর্তৃপক্ষকে। কয়েক বছর আগেই পদদলিত হয়ে শতাধিক হজযাত্রীর নিহত হওয়ার ঘটনাটা এখনও তরতাজা। এত বিশাল একটা ধর্মীয় জমায়েতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই পারে, কিন্ত সেটা যখন কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ঘটে, সৌদি যুবরাজকে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে গিয়ে যখন বিদেশ থেকে আসা হাজীদের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়, তখন সেটার চেয়ে অমানবিক আর কিছুই হতে পারে না।
আর আঞ্চলিক রাজনীতিতে মোড়লগিরি করার একটা হাতিয়ার হিসেবেও হজকে ব্যবহার করে সৌদি আরব। ইরানের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হজ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে ইরানকে শায়েস্তা করার জন্যে। এর আগে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মুসলমানদের হজে যাওয়ার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছিল। সৌদি আরবের বাদশাহ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের নাম বদলে যদি ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ রাখা হয়, তাহলে অনুমতি দেয়ার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্ত ধর্মনিরপেক্ষ একটা রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে বঙ্গবন্ধু সেই অন্যায্য দাবীর কাছে মাথানত করেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, সৌদি আরব এই কাজটা করতে পারে কিনা। কে হজ করবে, কার হজ করার অধিকার আছে, কার নেই, সেটা ঠিক করার ভার তো সৌদি সরকারকে কেউ দেননি।
দিনশেষে হজ মুসলমানদের কাছে ধর্মীয় একটা অনুসঙ্গ, স্রষ্টার নৈকট্য লাভের একটা পথ। আর সৌদি আরবের কাছে সেটা একটা লাভজনক ব্যবসা মাত্র! সেই ব্যবসা দিয়েই ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে সৌদি অর্থনীতি।
তথ্যসূত্র- বিবিসি, দ্য টেলিগ্রাফ, আরব নিউজ, রয়টার্স।।।
No comments