মারিয়ানা ট্রেঞ্চ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চঃ
====================

তলদেশে মারিয়ানা ট্রেঞ্চই পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম প্রদেশ গভীরতা তার ১১.০৩ কিলোমিটার। অর্থাৎ আস্ত একটি হিমালয় পর্বত ( উচ্চতা ৮.৮৪ কিলোমিটার) এই ট্রেঞ্চে ঢুকে যাবে নির্দিধায়, তারপরেও ২.১৯ কিলোমিটার অথৈ জল খেলা করবে হিমালয়ের মাথার উপর দিয়ে।
আপনি কি জানেন মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর মতো অসংখ্য ট্রেঞ্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাগর মহাসাগরের তলদেশে?
এই ট্রেঞ্চগুলো আর কিছুই নয় কেবল সাগর মহাসাগরের তলদেশ (Abyssal Plain) থেকে নেমে যাওয়া সরু এবং বিস্তৃত “V” আকৃতির এক একটি ফাটল বা খাদ।
সমুদ্র মহাসমুদ্রের তলে এরকম ২২টি ট্রেঞ্চের সন্ধান পেয়েছেন এ পর্য্যন্ত সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। এর আঠেরোটিই আছে প্রশান্ত মহাসাগরে।
আর্কটিক মহাসাগরের গড় গভীরতা ১.০৩৮ কিলোমিটার (৩৪০৭ ফুট) আর এখানের সর্বনিম্ন অঞ্চল ইউরেশিয়ান বেসিন এর গভীরতা ৫.৪৫০ কিলোমিটার (১৭৮৮১ ফুট)। আমাদের কাছের ভারত মহাসাগরের গড় গভীরতা ৩.৮৭২ কিলোমিটার (১২৭৪০ ফুট) আর এর গভীরতম অঞ্চল জাভা ট্রেঞ্চ নেমে গেছে ৭.৭২৫ কিলোমিটার (২৫৩৪৪ ফুট) নীচে। আটলান্টিক মহাসাগর আমাদের ভারত মহাসাগরের চেয়ে প্রায় ৫০০ ফুট কম গভীর। এখানে যে গভীর ট্রেঞ্চটির দেখা মিলবে তার নাম পুয়ের্টোরিকো ট্রেঞ্চ যার গভীরতা ৮.৬৪৮ কিলোমিটার (২৮৩৭৪ ফুট) জাভা ট্রেঞ্চের চেয়ে যা এক কিলোমিটার বেশী গভীর। ৪.১৮৮ কিলোমিটার (১৩৭৪০ ফুট) গভীরতা নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর হলো সবচেয়ে গভীর মহাসাগর আর এখানে দেখতে পাওয়া অনেক ট্রেঞ্চের মধ্যে মারিয়ানাই হলো গভীরতম ট্রেঞ্চ।


এই “মারিয়ানা” কে? মারিয়ানা হলেন সতের শতকের স্পেনের রানী, স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপের পত্নী। ১৬৬৭ সালে স্পেনিয়ার্ডরা প্রশান্ত মহাসাগরের যে দ্বীপগুলো দখল করে কলোনী প্রতিষ্ঠা করেন, রানীর সম্মানার্থে তার অফিসিয়াল নামকরন করেন “লা মারিয়ানাস”। আর এই ট্রেঞ্চটি মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের একদম কাছে বলে এর নামটিও হয়ে যায় “মারিয়ানা ট্রেঞ্চ”। অন্যান্য সব ট্রেঞ্চের মতো এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের জন্মও হয়েছে মাটির পৃথিবীর অভ্যন্তরে সচল “টেকটোনিক প্লেট”গুলোর ধাক্কাধাক্কির ফলে। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে রয়েছে এরকম দু’দুটো সচল প্লেট। এর একটি “পেসিফিক প্লেট” (Pacific Plate)। দৈত্যাকৃতির এই পেসিফিক প্লেটটি পশ্চিমে সরতে সরতে ইওরেশিয়ান প্লেটের (Eurasian Plate) সাথে সংঘর্ষে জাপানের পুবদিকে তৈরী করেছে অসংখ্য আগ্নেয়গিরি সহ ডুবন্ত পাহাড় শ্রেনীর। আর দক্ষিন পশ্চিমে রয়েছে যে নবীন ফিলিপিন প্লেট (Philippine Plate) তার সাথে সংঘর্ষে গিয়ে লজ্জায় ডুব (subduct) দিয়েছে ফিলিপিন প্লেটের নীচে।
পানির চাপ এতটাই যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুচাপের তুলনায় তা ১০০০ গুণেরও বেশি! এ কারণেইএখানে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির ঘনত্বওপ্রায় ৫ শতাংশ বেশি।অপেক্ষাকৃত তরুন ফিলিপিন প্লেটের সাথে বুড়ো বয়সে (আনুমানিক ১৭০ মিলিয়ন বছর পুরোনো) তার এরকম লাগতে যাওয়া ঠিক হয়নি এটা ভেবেই হয়তো। আর এই ডুব দিতে গিয়েই জন্ম হয়েছে অতিকায় এবং গভীর মারিয়ানা ট্রেঞ্চের। সাথে সাথে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জেরও। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা ৩৬ হাজার ফুট। আর এটিই হলো এ পর্য্ন্ত জানা পৃথিবীর গভীরতম অঞ্চল। আর জাপান নামের দেশটি রয়েছে এই তিন তিনটি – Pacific, Philippine, Eurasian প্লেটের থাবার মুখে। এদের জটিল বিবর্তন (চরিত্র) বা “খাসলত” বুঝে ওঠা ভার। আর তাই জাপান থাকে সর্বক্ষন ঝুঁকির মুখে।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চেরও গভীরতম অঞ্চল হলো গুয়াম দ্বীপের ২১০ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত “চ্যালেঞ্জার দীপ”। যে নামটি এসেছে ব্রিটিশ অনুসন্ধানী নৌযান HMS Challenger এর নামানুসারে। ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৮৭৬ সালের মে মাস পর্য্ন্ত পরিচালিত অনুসন্ধানে জাহাজটি এর গভীরতা মেপেছিলো ৪৪৭৫ ফ্যাদম বা ২৬৮৫০ ফুট।


১৮৯৯ সালে USS Nero নামের আর একটি মার্কিন অনুসন্ধানী নৌযান এর গভীরতা ৫২৬৯ ফ্যাদম বা ৩১৬১৪ ফুট বলে ঘোষনা করে। এ পর্য্ন্ত মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপতে ডিরেক্ট ইনডিরেক্ট অনেক অভিযান চালানো হয়েছে তবে মাত্র তিনটি সাবমার্সিবল বা ডুব জাহাজের অভিযান সফল বলে ধরা হয়।


১৯৬০ সালে মানুষ চালিত মার্কিন নৌবাহিনীর ডুবজাহাজ Trieste, ১৯৯৬ সালে মনুষ্যবিহীন ROVs Kaikō এবং ২০০৯ সালে Nereus এর যে গভীরতা মাপতে পেরেছে তা প্রায় ১০৯০২ থেকে ১০৯১৬ মিটার বা ৩৫ হাজার ৯০০ ফুটের কাছাকাছি। চ্যালেঞ্জার দীপের এই গভীরতা তাকে পৃথিবীর শীতলতম স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। আর এখানেই আছে হাজারো প্রজাতির অমেরুদন্ডী প্রানী এবং মাছ যারা এখানের জলের ঠান্ডা গরম আর অত্যাধিক চাপময় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে পেরেছে। গভীরতার কারনে এটি যেমন একাধারে হিমশীতল, তেমনি টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষে উৎপন্ন “হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট” এর কারনে এর আশেপাশের জলীয় পরিবেশের তাপমাত্রা ৩০০ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্য্ন্ত উঠে যেতে পারে। এতে পানির বাষ্প হয়ে যাওয়ার কথা।কিন্তু হচ্ছেনা, কারন চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা বিপুল হিমশীতল পানির জন্যে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসের চাপের চেয়ে এখানে পানির চাপ ১০০০গুন বেশী। এই সব বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে পারে কেবল “ব্যারোফিলিক” ব্যাকটেরীয়া আর বিশেষভাবে অভিযোজিত (?) প্রানীরা।
আপনি জানেন যে, ব্যাকটেরীয়া সবোর্চ্চ যতোটুকু তাপ সহ্য করতে পারে তা ১১৩ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর প্রানীরা পারে ৫০ডিগ্রী সেলসিয়াস। “হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট” এর কাছাকাছি একটি মাত্র প্রানীই বেঁচে বর্তে থাকতে পারে সে হলো এক ধরনের ‘ভেন্ট ক্রাব” (Bythograea thermydron)।


এরা এখানে থাকে প্রচুর প্রচুর পরিমানে। আর এই সুযোগে চতুর সমুদ্র বিজ্ঞানীরা এদের উপস্থিতি দেখে বলে দিতে পারেন কোথায় সমুদ্রগর্ভে আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হতে যাচ্ছে। হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের গরম পানির ফোয়ারা থেকে ছড়িয়ে পড়ে হাইড্রোজেন সালফাইড আর অন্যান্য মিনারেলস। ব্যারোফিলিক ব্যাকটেরীয়ারা এগুলো খেয়েই বেঁচে থাকে আর অন্যান্য অনুজীবেরা বাঁচে ব্যাকটেরীয়াগুলো খেয়ে। মাছেরা আবার এই অনুজীবগুলো খেয়ে বেঁচে বর্তে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। এই ভীষন বৈরী পরিবেশে বেঁচে থাকতে হলে তাদের শরীর গঠিত হতে হয় বিশেষ ধরনের প্রোটিন দ্বারা।
এদের চরিত্রের আর একটি চমকের দিক হলো এরা বেঁচে থাকে লম্বা সময় ধরে। একশো বছরেরও বেশী এরা বেঁচে থাকে যদি না জেলেদের জালে এরা ধরা পড়ে। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, এরা এই পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্যে বিবর্তিত এবং অভিযোজিত হয়েছে। যা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আপনার এই ধারনাকে সমুদ্র বিজ্ঞাণীরা বলছেন, ভুল ধারনা। এরা কোনও বিবর্তনের ফল নয়। বরং উল্টো। এরা সম্ভবত এই পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক জীবের নমুনা। যেমনটি ভারত মহাসাগরের গভীর তলদেশে প্রাপ্ত “কোয়েলাকান্ত” (Coelacanth)
নামক জলজপ্রানীটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কোনও বিবর্তন (evolution) এর মধ্যে দিয়ে যায়নি, অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। তেমনি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের প্রানীরাও।
নামক জলজপ্রানীটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কোনও বিবর্তন (evolution) এর মধ্যে দিয়ে যায়নি, অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। তেমনি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের প্রানীরাও।
----------------------------------
Shakh al Imran
No comments