ঘুমের মধ্যে বিভতস স্বপ্নগুলি আসলে কি এবং কেন ?
ঘুমের মধ্যে বিভতস স্বপ্নগুলি আসলে কি এবং কেন ?
স্লিপ প্যারালাইসিস!
ঘুমের ঘোরে কতোবার উপলব্ধি করেছেন যে একটা বীভৎস শয়তানের মত কিছু আপনার বিছানার পাশে বসে আছে আর সেটা শক্ত করে আপনাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখেছে? আপনি নড়তে পারছেন না, এমনকি মুখ ফুটে শব্দও বের হচ্ছে না। কেউ হয়তো একবার, কেউ দুইবার বা তিনবার বা বহুবার জীবনে এই ধরণের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। কেউ কেউ আবার এইধরণের ঘটনার নিত্যদিনের সাক্ষী। যারা পরের ক্যাটাগরিতে পড়েন তাদের দশা একপ্রকার করুণই বলা চলে। তাদের গলায় পাঁচ পদের, হাতের বাহুতে সাত পদের আর কোমরে তের পদের তাবিজ-কবজ সর্বদা বয়ে নিয়ে চলতে হয়।
কিন্তু এই ঘটনা ঘটার কারণ কি?
কেন হঠাৎ জ্বিন-পরীরা আপনার প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে পড়লো? ঘটনা আর কিছুই না- স্লিপ প্যারালাইসিস।
যারা স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু প্যারালাইজড অবস্থায় থাকার সময় বিছানার পাশে দুই-চারটা জ্বিন-পরী বসে থাকতে দেখেননি তাদের সংখ্যা ‘পুরোপুরি শূন্য’। পৃথিবীর প্রত্যেকটা স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিই তার মাথার কিংবা পায়ের দিকে অশুভ কিছু একটা বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার অস্তিত্ব অনুভব করেছেন।
আসল ঘটনায় যাবার আগে আমরা কিভাবে ঘুমাই সেটা একটু বলে নেই। আমরা যতক্ষণ জেগে থাকি এবং কাজ করি আমাদের শরীরে ‘এডেনোসিন (Adenosine)’ জমতে থাকে এবং আমরা একটু একটু করে ক্লান্ত হয়ে পড়তে থাকি। যখন আমরা ঘুমাই তখন মূলত এই এডেনোসিনগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে থাকে। আমরা যখন ঘুমাবার জন্যে শুই তখন শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘মেলাটোনিন (Melatonin)’ হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর কাজই হলো পুরো শরীরে তন্দ্রাভাব এনে দেয়া। আবার যখন শরীর জাগতে শুরু করে তখন মেলাটোনিন সরে গিয়ে সেখানে ভীড় করতে শুরু করে ‘কর্টিসল (Cortisol)’। এই হরমোনের কাজ হলো শরীরকে জানান দেয়া যে ঘুম মোটামুটি ফুরিয়ে এসেছে।
ঘুমের সময় আমাদের শরীরকে প্যারালাইজড করে রাখা হয় আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই (আপনার পাশে যিনি শুয়ে আছেন তার নিরাপত্তাও এইক্ষেত্রে বিবেচ্য)। এই ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক চক্রাকারে পাঁচটা ধাপ অতিক্রম করে। স্টেজ-১, স্টেজ-২, স্টেজ-৩, স্টেজ-৪ এবং রেম স্লিপ (Rapid Eye Movement Sleep)। এর মধ্যে স্টেজ-১ হলো সবচেয়ে হালকা ঘুম। আর স্টেজ-৪ হলো সবচেয়ে ভারী ঘুম। এই স্টেজের ঘুমে থাকা মানুষগুলোকে জাগানো খুব কঠিন।
স্লিপ প্যারালাইসিস ঘটে তখনই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শরীর জাগার আগেই আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি জেগে উঠে। যখন সে টের পায় শরীর এখনো জেগে উঠেনি তখন শুরু হয় হ্যালুসিনেশান। শরীর কেন জেগে উঠেনি সেটার ব্যাখ্যা দাঁড়া করাতে সে ঘোরের ভেতরে থেকেই জ্বিন-পরী-ভূত ইত্যাদি আপনার আশেপাশে পয়দা করতে শুরু করে। কিন্তু যখনই আপনার শরীরে অনুভূতি ফিরতে শুরু করে তখনই দেখবেন এইসব ভূতেরা একে একে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
অনেক সময় স্লিপ প্যারালাইসিসের উলটো ঘটনাও ঘটে। এটাকে বলে ‘হিপনিক মায়োক্লোনিয়া (Hypnic Myoclonia)’। এইক্ষেত্রে মস্তিষ্ক পুরোপুরি জাগার আগেই শরীর জেগে উঠে। ফলে দেখা যায় সেই অশুভ আত্মারা আপনার হাত কিংবা পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারছে, বিছানা হতে টেনে ফেলে দিচ্ছে, কিংবা আদর করে(!) মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সর্বনিম্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, আপনার মনে হচ্ছে কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে, অথচ আপনি বিছানার উপরেই শুয়ে আছেন। এই ব্যাপারটা ঘটে থাকে স্টেজ-১ এর ঘুমে থাকার সময়। অর্থাৎ স্টেজ-১ এর ঘুমে থাকার সময় শরীর আচমকা জেগে ওঠার ব্যাপারটা অনেকটা কোন গাড়ি সরাসরি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ গিয়ারে স্টার্ট করার মতো। যারা গাড়ি কিংবা বাইক চালান তারাই ব্যাপারটা বুঝবেন।
যেহেতু এখন স্লিপ প্যারালাইসিস সম্পর্কে জানলেন সুতরাং এটা নিয়ে এখন আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু যারা একটু বেশি ভুগছেন এই ধরণের সমস্যায় তারা জলদি ডাক্তার দেখান। এটা আপনার ঠিকমত ঘুম না হওয়াজনিত সমস্যা।
তথ্যসূত্রঃ বিজ্ঞানযাত্রা
No comments